বিবাহ, বিপ্লব ও বিতর্ক: একত্রে রাজনীতির নির্মম বাস্তবতা

 বিবাহ, বিপ্লব ও বিতর্ক: একত্রে রাজনীতির নির্মম বাস্তবতা
-  তৌহিদ রাসেল


একবার ডা. জাকির নায়েকের এক প্রোগ্রামে একলোক  বললেন, 

— “আমার নারীর প্রতি কোনো মোহ কাজ করে না।”

জবাবে ডা. জাকির নায়েক হেসে বললেন,

 — “তাহলে আপনি ভালো কোনো ডাক্তারের কাছে যান!”


এটাই হলো প্রকৃতির চিরন্তন সত্য — পুরুষ মাত্রই নারীর প্রতি এক প্রকার মোহ, একরকম আকর্ষণ অনুভব করে। এই ব্যাপারটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই তো যুগে যুগে এই মোহ, এই আকর্ষণ কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত সব ঘটনা।


হাবিল কাবিলের কাহিনি হোক কিংবা ট্রয়ের হেলেন, মিসরের ক্লিওপেট্রা হোক বা রানী সেবার সাথে সলোমান— সব গল্পের পেছনেই তো আছে এক নারীকে ঘিরে পুরুষের দুর্বার টান। তাই বলতেই হয়— নারী শুধু সৌন্দর্যের প্রতীক না, ইতিহাসের অনেক অধ্যায়ের অনুপ্রেরণাও বটে।


নবুয়তের শুরুর সময়টায় সবাই যখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, তখন একজন নারী — হযরত খাদিজা (রাঃ) ছিলেন রাসুল (সাঃ)-এর সবচেয়ে বড় সাহস। তার ভালোবাসা, বিশ্বাস আর সহযোগিতায়ই নবুয়তের প্রথম ধাপগুলো সম্ভব হয়েছিল।


স্ত্রী মমতাজের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছিলেন সম্রাট শাহজাহান। তার জন্যই তৈরি করলেন ভালোবাসার অমর স্মৃতি — তাজমহল। আজও দাঁড়িয়ে আছে, প্রমাণ করে — সত্যিকারের প্রেম কখনো মরেনা।


পাকিস্তানের ইমরান খান শুধু বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেটার বা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নয়, তার ব্যক্তিগত জীবনের প্রেমকাহিনিও বারবার রাজনীতির মোড় ঘুরিয়েছে। তার তিনটি বিয়ে তাকে তিনটি ভিন্ন সময়ে তিনটি ভিন্ন ইমেজ উপহার দিয়েছে।


প্রথম স্ত্রী জেমাইমা ছিলেন ধনী ব্রিটিশ পরিবারের মেয়ে। এই বিয়ের পর ইমরান খান হয়ে উঠেন এক আধুনিক, উদারপন্থী নেতার প্রতিচ্ছবি। পশ্চিমা গণমাধ্যমেও তখন তাকে এক ধরনের "গ্লোবাল আইকন" হিসেবে দেখা হতো।


দ্বিতীয় স্ত্রী রেহাম খান ছিলেন সাংবাদিক ও টেলিভিশন উপস্থাপক। এই বিয়েটা খুব বেশি দিন টেকেনি, কিন্তু সে সময় মিডিয়া এবং রাজনীতির আলোচনায় ইমরান খান আরও গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েন।


তৃতীয় স্ত্রী বুশরা বিবি, যিনি একজন ধর্মপরায়ণ, পর্দানশীন নারী। তার সঙ্গে বিয়ের পর ইমরান নিজেকে উপস্থাপন করেন ইসলামি ভাবধারার অনুসারী হিসেবে। এই রূপান্তর তাকে এক নতুন ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতার অবস্থানে দাঁড় করায়।


একজন ইমরান খান, তিনটি নারী, তিনটি প্রেম—আর তিনটি আলাদা রাজনৈতিক ব্যাখ্যা। প্রেম এখানে শুধু ব্যক্তিগত ছিল না, বরং রাজনৈতিক প্রতিচ্ছবিরও ধারক ছিল। তাই বলা যায়, ভালোবাসা অনেক সময় নীরবে চালিয়ে দেয় বড় রাজনীতির খেলা।


চে গুয়েভারার প্রথম স্ত্রী হিল্ডা, পেরুর একজন অর্থনীতিবিদ ও কমিউনিস্ট নেত্রী ছিলেন। তাঁরা ডিসেম্বর ১৯৫৩-তে গ্যুয়েতেমালায় পরিচিত হন, ১৯৫৫ সালে বিবাহ করেন, এবং ১৯৫৬ সালে এক মেয়ের বাবা হন। হিল্ডা ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক ও মানসিক ভিত্তি—তিনি চে'কে কিউবান বিপ্লবের দিক দেখান।


১৯৫৯ সালে তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন আলেইদা মার্চের সাথে, যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে বিপ্লবীদের জন্য বার্তা নিয়ে যাওয়া কাজ করতেন। আলেইদা ছিলেন তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী। একাধিক সময় দু'জন মিলে যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু পর্যন্ত হাত ধরেছিলেন। চে’এর প্রেম ছিল রাজনৈতিকভাবে গভীর প্রভাবশালী—হিল্ডার মাধ্যমে বিপ্লবের প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা লাভ এবং আলেইদার মাধ্যমে যুদ্ধ ও বিপ্লবকে আরও ব্যক্তিগতভাবে জারি রাখা।


শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান ও শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক — তিনজনই রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয় হওয়ার আগেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

তাদের সেই জীবনসঙ্গীরাই পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন নির্ভরতার প্রতীক, নিঃশব্দ শক্তি এবং রাজনৈতিক পথচলার অন্যতম সহযোদ্ধা।


রাজনীতি আর রোমান্স – এই দুই জিনিস ঠিকভাবে না মিললে কত বড় নেতা যে পড়ে যান, তার প্রমাণ ইতিহাসেই আছে। যেমন ব্রিটিশ মন্ত্রী জন প্রোফুমো। ৬০’র দশকে এক মডেলের প্রেমে পড়লেন, যিনি আবার সোভিয়েত স্পাইয়ের সাথেও সম্পর্ক রাখতেন! ঘটনাটা ফাঁস হতে না হতেই তার ক্যারিয়ার শেষ। ব্রিটিশ কনজারভেটিভ সরকারও সেই ধাক্কা সামলাতে পারেনি।


আরেকটা ঘটনা। সিআইএ’র সাবেক ডিরেক্টর ডেভিড পেট্রিয়াসের। ভদ্রলোক নিজের জীবনী লেখিকার সাথেই প্রেমে জড়িয়ে পড়েছিলেন। যদিও সবকিছু গোপনে চলছিল, কিন্তু এফবিআই যখন জানলো, তখন আর রক্ষা হলো না। তাকে পদত্যাগ করতেই হলো। ভাবো দেখি, আমেরিকার গোয়েন্দা প্রধান নিজের গোপনই গোপন রাখতে পারলেন না!


ফিলিপাইনের লেইলা ডে লিমা – এক সময়ের বিচারমন্ত্রী। তাঁর বিরুদ্ধেও প্রেম ও সম্পর্কজনিত কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠে, যেখানে তাঁর ড্রাইভারই ছিল মূল চরিত্র! সেই ড্রাইভার আবার জড়িত ছিল মাদকের সাথে। এসব ঘিরে তাকে রাজনীতি থেকে প্রায় ছিটকে ফেলা হয়, জেলও খাটতে হয়।


আর কানাডার পট্টি স্টার – প্রেম আর ক্ষমতার লোভ একসাথে গিলে ফেললো তার রাজনৈতিক জীবন। অবৈধভাবে অনুদান নিয়ে নির্বাচনী তহবিলে ঢুকিয়ে ধরা খেলেন। পরে কারাদণ্ড, ক্যারিয়ার শেষ। এভাবে দেখলে, প্রেম ভুল সময়ে বা ভুল মানুষকে করলে শুধু মন না, মসনদও হারাতে হয়!


পুরুষদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার প্রায়ই শেষ হয়ে যায় নারীর নাম জড়িয়ে কেলেংকারি বা অর্থনৈতিক দুর্নীতির অভিযোগে। আর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ অনেক সময় ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ছড়ায় ভুল তথ্য, যাতে একজন ব্যক্তি তার সমাজে এবং রাজনীতিতে হেয়প্রতিপন্ন হয়। এই ধরণের অপপ্রচার নেতার বিরুদ্ধে মানুষজনের ধারণা খারাপ করে এবং তার রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল করে।


অর্থাৎ, শুধু বিচার কিংবা আইন নয়, রাজনৈতিক শত্রুর এই ধরনের কৌশল অনেক সময় একজন নেতার রাজনীতির শেষ সীমানা হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিক আঘাত আর মানসিক চাপও বড়ো অস্ত্র হয় এই যুদ্ধে।

এই সময়ের তরুণ রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই নারী কেন্দ্রিক ঝামেলা এড়াতে আগেভাগেই বিয়েটা সেরে ফেলছে। যেমন  নুরুল হক নুর, নাহিদ, হাসনাত—তারা সম্ভবত খুব ভালো করেই বুঝেছে, রাজনীতিতে অর্থনৈতিক বা নারীঘটিত কেলেংকারি একটা ভয়ংকর ফাঁদ হতে পারে।


তবে দুঃখের বিষয়, যেখানে নুরুল হক নুর ২০২৪ সালের রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের ফ্রন্টলাইন লিডার হতে পারতেন, সেখানে অর্থনৈতিক কেলেংকারিতে জড়িয়ে এখন তার নামই হয়ে গেছে “বিকাশ নুরু”! যাদের রাজনৈতিক মাঠে গুরু ছিল নুরু, সেই নাহিদ-আসিফরাই এখন দৃশ্যপটে এগিয়ে। আর এটা তারা তাদের নিজস্ব যোগ্যতায় অর্জন করেছে।


অন্যদিকে এনসিপির তুষার—একজন টকশো কাপানো সম্ভাবনাময় তরুণ নেতা, তার পথও থেমে গেল প্রায়। আজরাইল আসার আগেই ইস্রাফিল সিঙ্গায় ফু দিয়ে দিল! মানে,  নীলা ইস্রাফিলের কথোপকথনের ‘কনভার্সেশন কেলেংকারি’ তার পুরো ক্যারিয়ারটাই ধ্বংস করে দিলো বোধহয়।


তাই আমার ব্যক্তিগত ভাবনা—তরুণ রাজনীতিকদের উচিত সময় থাকতেই বিয়েটা সেরে ফেলা, যাতে নারীঘটিত কোনো ফাঁদে না পড়তে হয়। আর অর্থনৈতিক লেনদেনে থাকতে হবে শতভাগ সতর্ক। এই দিক থেকে বলতে গেলে, নাহিদ-হাসনাতরা সত্যিই একধাপ এগিয়ে।


সর্বশেষ বলতে চাই—রাজনৈতিক হোক, সামাজিক হোক কিংবা ধর্মীয় সংগঠন—সবখানেই সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকা দরকার নারী ও অর্থনৈতিক ইস্যুতে। কারণ এই দুইটা বিষয় মানুষের মাঝে সবচেয়ে দ্রুত, সবচেয়ে নেতিবাচকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। আর এর প্রভাব হয় দীর্ঘমেয়াদি, অনেক সময় পুরো ক্যারিয়ারই ডুবিয়ে দেয়।


অন্যদিকে, বিবাহিত জীবন অনেক সময় মানুষের পথচলাকে সহজ করে দেয়। ইতিহাসে আমরা দেখি—পৃথিবীর যত বড় বড় সফল মানুষ আছে, তারা প্রায় সবাই বিয়ের পরই স্থির হয়ে কাজ করতে পেরেছে। কারণ একজন জীবনসঙ্গী শুধু সংসার না, সে হয় একজন পরামর্শদাতা, মানসিক শান্তির জায়গা। যেমন, আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনে খাদিজা (রাঃ) এক বিশাল ভূমিকা রেখেছেন। তিনি শুধু একজন স্ত্রী না, ছিলেন নবীর সবচেয়ে বড় সাপোর্ট।


এই জন্যই তো কবি বলেছেন—

"যা কিছু কল্যাণকর, তার অর্ধেকে করিয়াছে নারী আর অর্ধেক তার নর।"

আর ইসলামেও বলা হয়েছে, "যে বিয়ে করলো, সে দ্বীনের অর্ধেক পূর্ণ করলো।"


Comments

Popular posts from this blog

সমকাম বা হোমোসেক্সুয়াল

বিভিন্ন ধর্মে নারীর পর্দা- তৌহিদ রাসেল

এক নজরে দোহার উপজেলা