বিভিন্ন ধর্মে নারীর পর্দা- তৌহিদ রাসেল
বিভিন্ন ধর্মে নারীর পর্দা
তৌহিদ রাসেল
আমি যে শহরে থাকি সেই শহরের সুপরিচিত একটি কোচিং সেন্টারের অফিসে বসে আছি। আমার পরিচিত এক ভাই এই কোচিং-এর পরিচালক। নতুন ব্যাচ শুরু হয়েছে তাই তিনি ক্লাসে গিয়েছেন উদ্বোধনী ক্লাসে কিছু বক্তব্য রাখতে। আমাকে এখানে প্রায় আসতে হয় কিছু দায়িত্ব পালনের জন্য। অফিসের একটি ছেলে আমাকে এক কাপ কফি দিয়ে বললো 'ভাইয়া আপনি বসেন, স্যার ১০/১২ মিনিটের ভিতর বক্তব্য শেষ করে দিবে'।
ভাবলাম আয়েশ করে টাইম নিয়ে কফি টা খেয়ে নেই। ১০/১২ মিনিটের জায়গায় ২০ মিনিটের বেশি সময় চলে গেল। কফি খাওয়া শেষ সেই কখন, কিন্তু ভাইয়ের আসার নাম গন্ধ নেই। সিনিয়র মানুষদের এই এক সমস্যা, যদি একবার বক্তব্য শুরু করে শেষ করার হিসাব থাকে না। অনেকক্ষণ বক্তব্য দেওয়ার পর বলবে 'আর একটি কথা না বললেই নয়' এই বলে আবারও আরেক টপিকে নিয়ে নতুন করে বক্তব্য শুরু করে দিবে। আর এই দিকে ছাত্রছাত্রীরা কিছুক্ষণ পরে মুচড়ামুচড়ি শুরু করে দেয় আর হাই তুলতে থাকে।
আর এইদিকে আমি বক্তব্য না শুনেই বিরক্ত হচ্ছি। আমারও মুচড়ামুচড়ি শুরু হয়ে গেছে, হাই তুলতেও ইচ্ছা করতেছে। যাইহোক, যখন বিরক্তিবোধ হচ্ছিলাম ঠিক তখনই একটি মেয়ে অফিস রুমে ঢুকলো। মেয়েটি একটি ভর্তি রশিদ আমার সামনে বাড়িয়ে দিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো 'স্যার জ্যামের কারণে আমার আসতে দেরি হয়ে গেছে। আমাদের অরিয়েন্টেশন ক্লাসটা কোথায় হচ্ছে স্যার?' আমি একবার ভর্তি রশিদের দিকে তাকাচ্ছি আরেকবার মেয়েটির দিকে।
ভর্তি রশিদে লেখা 'অঞ্জলি পাল অনু' এবং মেয়েটির মাথায় উড়না দিয়ে প্যাঁচানো যেভাবে মুসলিম মেয়েরা সাধারণত উড়না মাথায় পেঁচিয়ে রাখে। আমার সন্দেহ হলো। হয়তো ভুলে মেয়েটি ভর্তির সময় অন্য কারো ভর্তি রশিদ নিয়ে গিয়েছিল।
জিজ্ঞেস করলাম, - নাম কী আপনার?
- স্যার, অঞ্জলি পাল অনু।
- আচ্ছা ঠিক আছে আপনি ৫১৩ নাম্বার হল রুমে চলে যান সেখানে অরিয়েন্টেশন ক্লাস হচ্ছে।
বোরকা, হিজাব অথবা উড়না দিয়ে পেঁচিয়ে মাথা ঢাকলে আমি কেন পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ ভাববে মেয়েটি মুসলিম। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের মাথায় ঢুকে গেছে যে বোরকা, হিজাব বা মাথা ঢেকে উড়না পরা শুধু মুসলিম নারীদের জন্য ধর্মীয় বিধান, অন্য কোনো ধর্মে এটা নেই। আসলে এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। এক সময় আমিও এই ভুল ধারণার ভিতরেই ছিলাম। অধিকাংশ মানুষই জানেনা যে নারীদের পরিপাটি পোশাক পরা এবং দেহ ঢেকে রাখা সকল ধর্মের ধর্মীয় বিধান।
আমার সাথে অমুসলিমদের সাথে যাদের দেখা হয় তাদের অধিকাংশই হিন্দু। হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থে বলা হয়েছে 'যেহেতু ব্রহ্মা তোমাদের নারী করেছেন তাই দৃষ্টিকে অবনত রাখবে, উপরে নয় । নিজেদের পা সামলে রাখো । এমন পোষাক পড়ো যাতে কেউ তোমার দেহ দেখতে না পায়।' [ঋকবেদ ৮।৩৩।১৯]
এছাড়াও ঋগ্বেদের অন্য এক জায়গায় আছে, 'হে নারী! তুমি নিচে দৃষ্টি রাখো, উর্ধ্বে দৃষ্টি করিও না। আপন পদযুগল একত্রে মিলিয়ে রাখো। আর তোমার নাক যেন অন্য কেউ দেখতে না পায়।'
আচ্ছা যদি কোনো মেয়ে তার দেহ ঢেকে রাখে এবং নাক কেউ দেখতে না পায় তাহলে তাকে কেমন পোশাক পরতে হবে! হিন্দু নারী যারা ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলে এবং ধর্মীয় শিক্ষা অন্যদের দেয় তাদের দেখা যাবে পুরো শরীর পোশাকে আবৃত রাখে।
ঋকবেদে আরও বলা হয়েছে- 'হে পুরুষ ও নারী তোমাদের দৃষ্টি সবসময় হোক ভদ্র ও অবনত। তোমাদের চলন হোক সংযত, দেহ হোক পোষাকে আবৃত, নগ্নতা হোক পরিত্যাজ্য।' [ঋগ্বেদ ৮।৩৩।১৯]
পার্শ্ববর্তী ভারতসহ হিন্দু ধর্মালম্বী অধিকাংশ শহুরে মেয়েদের দেখা যায় যে তারা ছেলেদের পোশাকের মত জিন্স এবং টি-শার্ট পরিধান করে বাহিরে বের হচ্ছে। অথচ হিন্দু ধর্মে নারী পুরুষের পোশাক আলাদা থাকার ব্যাপারে বলা হয়েছে। বেদে বলা হয়েছে-“মহিলারা পুরুষদের মতো পোশাক পরিধান করবে না এবং পুরুষরাও তাদের স্ত্রীদের পোশাক পরিধান করবে না। [ঋকবেদ ১০।৮৫।৩০]। এই শ্লোকের অন্য জায়গায় বলা হয়েছে- 'তোমরা তোমাদের ঐ শরীরকে বহু পুরুষের চক্ষু ইন্দ্রিয় হতে সর্বদা আগলে রাখবে। এমন স্থানে তোমরা স্নান সম্পন্ন করিও যেখানে কোনো পুরুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ হবে না’
পোশাকের ব্যাপারে হিন্দু ধর্মে নারীদের আরও কঠোরতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। হিন্দুধর্মীয় বইয়ে বলা হয়েছে - 'পতি নিদ্রিত হইলে, মনে মনে পতিকে চিন্তা করিতে করিতে তাহার পার্শ্বে নিদ্রা যাইবে। সেই সময় বিবস্ত্রা হইবে না, সতর্ক হইয়া শয়ন করিবে, অন্য কামনা-শূণ্য জিতেন্দ্রিয় হইয়া থাকিবে। অর্থাৎ স্ত্রীগণ পর-পরুষের সাথে তো দূরের কথা, নিজ স্বামীর সামনেও বিবস্ত্র হইতে পারিবে না।' [স্ত্রী ধর্মঃ ১৫৭]
বেদের অন্যর বলা হয়েছে, 'যে সকল নারী দেহ রূপ দেখিয়ে অপরের সাথে বন্ধুত্ব করতে চায়, তারা হায়েনার মতো, তাদের পরিত্যাগ করো। [ঋগবেদ ১০/৯৫/১৫]। পোশাকের বিধান হিসেবে বেদের অন্য এক জায়গায় বলা হয়েছে, 'এমন পোশাক পরিধান করো, যাতে তোমাদের কেউ দেখতে না পায়।' । এ গ্রন্থের অপর এক শ্লোকে বলা হয়েছে, ‘হে নারী! তোমার নাক যেন কেউ দেখতে না পায়! তুমি যদি এমন লজ্জাবতী হতে পারো, তাহলে নারী হয়েও তুমি সম্মানের পাত্রী হতে পারবে।’ [স্ত্রী ধর্মঃ১৪৭]
ইতিহাসের উৎস থেকে জানা যায় যে, প্রাচীন ভারতে নারীদের মধ্যে পর্দা প্রথার প্রচলন ছিল। প্রাচীন আর্য সমাজের নারীরা পর্দার এ বিধান মেনে চলতো। ভারতের উত্তরপ্রদেশে বসবাসকারী আর্য কুমারী মেয়েরা ভিন্ন ভিন্ন দুই খানা কাপড় পরিধান করতো। এ কাপড় দিয়ে তারা তাদের মাথা, মুখ ও দেহ ঢেকে রাখতো। এটা ছিল তাদের ধর্মীয় শাস্ত্রের অলঙ্ঘনীয় নির্দেশ।
চট্টগ্রামে থাকার সুবাদে অনেক বৌদ্ধ ধর্মের মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে। তাদের সাথে মিশেছি, তাদের ধর্ম সমন্ধে জানতে চেষ্টা করেছি। তাদের আচরণ গৌতম বুদ্ধের মতই ভদ্র, নরম এবং শালীন। বৌদ্ধ ধর্মের জনপ্রিয় একটি বাণী হলো 'অহিংসা পরম ধর্ম'।
আর এই ধর্মে নিশ্চয়ই পোশাকের ব্যাপারে শালীনতা অবলম্বন করবে এটাই স্বাভাবিক। বৌদ্ধ ধর্মীয় একটি গ্রন্থে পোশাকের ব্যাপারে বলা হয়েছে 'যাহাতে উদর, পেট ও স্তন দেখা না যায় সেইরূপভাবে বস্ত্র পরিধান করিবে ও গায়ে দিবে। সর্বদা পরিষ্কার বস্ত্র ব্যবহার করিবে। পুরুষ সম্মুখে চুল আঁচড়াইবেনা, এবং উকুন ধরিবেনা।' [গৃহীনীতি পর্ব: নারীদের কর্তব্য: ২৫৪ পৃষ্ঠা]
তার মানে পরপুরুষকে মাথার চুল দেখানো যাবেনা এবং বুকের উপরেও কাপড় দিতে হবে যাতে কিছু দেখা বা বুঝা না যায়। অর্থাৎ একজন মুসলিম মেয়ে যেমন পোশাক পরিধান করে তেমন পোশাক পরতে হবে।
নারীদের পোষাকের ব্যাপারে খ্রিষ্টান ধর্মে এমন ভাবে জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে পোষাকে শালীনতা না মানলে ইহকালেও শাস্তির বিধান করা হয়েছে। নিউ টেস্টামেন্টে বলা হয়েছে, 'কোন মহিলা মাথা ঢেকে না রাখলে তার মাথার চুল কামিয়ে দিতে হবে। যদি কোন মহিলার জন্য তার মাথার চুল কামিয়ে ফেলা অপমানজনক মনে হয় তাহলে সে যেন তার মাথা ঢেকে রাখে।' [১ করিন্থিয়ান্স ১১: ৫ পদ]
বাংলাদেশের খ্রিস্টান পরিবারগুলোর সাথে তেমনভাবে সাক্ষাত না হলেও নানদের অর্থাৎ সিস্টারদের সাথে দেখা হয়েছে। তারা সেভাবেই নিজেকে আবৃত করে যেভাবে মুসলিম নারীরা করে। তবে দুঃখের বিষয় হলো নান বা সিস্টার ছাড়া তেমন কোনো খ্রিষ্টান নারী তাদের ধর্মীয় পোষাক পরিধান করে না।
ইহুদিদের যখন পৃথিবীর কোথাও জায়গা হচ্ছিলো না তখন ব্যালফোর্ট চুক্তির কারণে ইহুদিরা মুসলিমদের অঞ্চলেই জায়গা পেয়েছিল। মুসলিমরা তাদের জ্ঞাতি ভাই হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু মুসলিমদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে এই ইহুদিরা। আর ফিলিস্তিনের কি অবস্থা তা তো বর্তমানে ঘটতেছেই।
সেই ইহুদি ধর্মেও নারীদের শালীন পোষাক পড়ার কথা বলা হয়েছে। ওল্ড টেস্টামেন্টে বলা হয়েছে 'আর বিবিকা যখন ইসহাককে দেখিলেন, তখন উট হতে নেমে দাসকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমাদের সাথে দেখা করতে যে আসতেছেন, ঐ পুরুষ কে? দাস বললো, উনি আমার কর্তা। তখন বিবিকা অতিরিক্ত কাপড় দিয়ে নিজেকে ঢেকে নিলেন।' [আদি পুস্তক ২৪:৬৪, ৬৫ পদ]
ইহুদী নারীদের সাধারণ পোশাকের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ ছিল নেকাব। তৎকালীন এই নেকাব দিয়ে তারা মাথা, মুখমন্ডল এবং বক্ষদেশ আবৃত করে রাখতো। আবার কখনও কখনও এই নেকাব পায়ের নিম্নদেশ পর্যন্ত নেমে যেতো। [এনসাইক্লোপিডিয়া, পৃ. ৫২৪৭]। বাইবেল অধ্যয়ন করলে খ্রিস্টান নারীদের পর্দা প্রথা সম্পর্কে একটা বিশেষ ধারণা পাওয়া যায়। খ্রিস্টান ধর্মে নারীদের পর্দার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। শালীনতা না মানলে ইহকালে তাদের জন্য শাস্তির বিধানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
পর্দার ব্যাপারে ইউরোপের গ্রিক সভ্যতাকেও বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতে দেখা যায়। গ্রীক সভ্যতা চর্চায় দেখা যায়, তাদের মাঝেও শালীন পোশাক পরার রীতি চালু ছিল। গ্রিক মেয়েরা ঘরের বাইরে যাওয়ার সময় ভিন্ন ভিন্ন কাপড় দিয়ে তাদের মুখমন্ডল এবং দেহ ঢেকে রাখতো। [Shaman antiquite Grecque St, p. 583]
ইসলাম বিশ্বজনীন এক চিরন্তন ও শাশ্বত পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামে রয়েছে নারীর সম্মান, মর্যাদা ও সকল অধিকারের স্বীকৃতি, রয়েছে তাদের সতীত্ব সুরক্ষা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাপক কর্মসূচী। তাদের সম্মান, মর্যাদা ও সতীত্ব অক্ষুন্ন রাখতেই ইসলাম তাদের উপর আরোপ করেছে হিজাব বা পর্দা পালনের বিধান।
মূলত ‘হিজাব বা পর্দা’ নারীর সৌন্দর্য ও মর্যাদার প্রতীক। নারীর সতীত্ব ও ইজ্জত-আবরুর রক্ষাকবচ। নারী-পুরুষ উভয়ের চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষার অতি সহজ ও কার্যকর উপায়। এ বিধান অনুসরণের মাধ্যমে হৃদয়-মনের পবিত্রতা অর্জন করা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এ বিধান তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কারণ।’ (সূরা আহযাব: ৫৩)
ইসলাম পর্দা পালনের যে বিধান আরোপ করেছে তা মূলত অশ্লীলতা ও ব্যভিচার নিরসনের লক্ষ্যে এবং সামাজিক অনিষ্টতা ও ফেতনা-ফাসাদ থেকে বাঁচার নিমিত্তেই করেছে। নারীদের প্রতি কোনো প্রকার অবিচার কিংবা বৈষম্য সৃষ্টির জন্য করেনি। বরং তাদের পবিত্রতা ও সতীত্ব রক্ষার্থেই তাদের উপর এ বিধানের পূর্ণ অনুসরণ অপরিহার্য করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতাকে দূরীভূত করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।’ (সূরা আহযাব: ৩৩)
এ জন্য পর্দা-বিধান ইসলামী শরীয়তের পক্ষ থেকে সাধারণভাবে সমাজ-ব্যবস্থার এবং বিশেষভাবে উম্মতের নারীদের জন্য অনেক বড় ইহসান। এ বিধানটি মূলত ইসলামী শরীয়তের যথার্থতা, পূর্ণাঙ্গতা ও সর্বকালের জন্য অমোঘ বিধান হওয়ার এক প্রচ্ছন্ন দলিল। মানবসমাজকে পবিত্র ও পঙ্কিলতামুক্ত রাখতে পর্দা বিধানের কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে বর্তমান সমাজের যুবক ও তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা ও নারীজাতির নিরাপত্তার জন্য পর্দা-বিধানের পূর্ণ অনুসরণ এখন সময়ের দাবি।
‘পর্দা’ শব্দটি মূলত ফার্সী। যার আরবী প্রতিশব্দ ‘হিজাব’। পর্দা বা হিজাবের বাংলা অর্থ- আবৃত করা, ঢেকে রাখা, আবরণ, আড়াল, অন্তরায়, আচ্ছাদান, বস্ত্রাদি দ্বারা সৌন্দর্য ঢেকে নেয়া, আবৃত করা বা গোপন করা ইত্যাদি। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়, নারী-পুরুষ উভয়ের চারিত্রিক পবিত্রতা অর্জনের নিমিত্তে উভয়ের মাঝে শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত যে আড়াল বা আবরণ রয়েছে তাকে পর্দা বলা হয়।
আবার কেউ কেউ বলেন, নারী তার বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ রূপলাবণ্য ও সৌর্ন্দয পরপুরুষের দৃষ্টি থেকে আড়ালে রাখার যে বিশেষ ব্যবস্থা ইসলাম প্রণয়ন করেছে তাকে পর্দা বলা হয়। মূলত হিজাব বা পর্দা অর্থ শুধু পোশাকের আবরণই নয়, বরং সামগ্রিক একটি সমাজ ব্যবস্থা, যাতে নারী-পুরুষের মধ্যে অপবিত্র ও অবৈধ সম্পর্ক এবং নারীর প্রতি পুরুষের অত্যাচারী আচরণ রোধের বিভিন্ন ব্যবস্থা রয়েছে।
পর্দা ইসলামের সার্বক্ষণিক পালনীয় অপরিহার্য বিধান। কোরআন-সুন্নাহর অকাট্য দলীল প্রমাণাদির ভিত্তিতে নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি বিধানাবলীর মতো সুস্পষ্ট এক ফরয বিধান। আল্লাহ তায়ালাই এ বিধানের প্রবর্তক। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন তোমরা তাদের নিকট কিছু চাইবে তখন পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এ বিধান তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কারণ’। (সূরা আহযাব: ৫৩)
এ বিধানের প্রতি পূর্ণ সমর্পিত থাকাই ঈমানের দাবি। এ বিধানকে হালকা মনে করা কিংবা এ বিধানকে অমান্য করার কোনো অবকাশ নেই। কেননা ইসলামী শরীয়তের সুস্পষ্ট বিধানের বিরোধিতা করার অধিকার কারো নেই। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ এবং তার রাসূল কোনো বিষয়ের নির্দেশ দিলে কোনো মু’মিন পুরুষ কিংবা কোনো মু’মিন নারীর জন্য সে বিষয় অমান্য করার কোনো অধিকার থাকে না। আর যে আল্লাহ ও তার রাসূলকে অমান্য করে সে অবশ্যই পথভ্রষ্ট।’ (সূরা আহযাব: ৩৬)
পর্দার গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে নবী আপনি আপনার স্ত্রী, কন্যা ও মু’মিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের জিলবাবের অর্থাৎ চাদরের একাংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা আহযাব: ৫৯)
এ আয়াতে পর্দার সঙ্গে চলাফেরা করার গুরুত্ব উল্লেখ করা হয়েছে যে, পর্দার সহিত চলাফেরা করলে সবাই বুঝতে পারবে তারা শরীফ ও চরিত্রবতী নারী। ফলে পর্দানশীন নারীদেরকে কেউ উত্যক্ত করার সাহস করবে না। প্রকৃতপক্ষে যারা পর্দাহীনভাবে চলাফেরা করে অধিকাংশ সময় তারাই ইভটিজিং ও ধর্ষণসহ নানা রকমের নির্যাতনের সম্মুখীন হয় এবং রাস্তাঘাটে তারাই বেশি ঝামেলার শিকার হয়। তাই নারীর সতীত্ব ও ইজ্জত-আবরু রক্ষার্থে পর্দার গুরুত্ব অপরিসীম।
হাদীস শরীফেও পর্দার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন, নারী পর্দাবৃত থাকার বস্তু। যখন সে পর্দাহীন হয়ে বের হয় তখন শয়তান তার দিকে চোখ তুলে তাকায়। (তিরমিযী: ১১৭৩)
অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আলী (রা.) বর্ণনা করেন, একদা তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকটে ছিলেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (সাহাবীদের উদ্দেশ্যে) বললেন, মহিলাদের জন্য সর্বোত্তম বিষয় কোনটি? তারা চুপ হয়ে গেলেন। (কেউ বলতে পারলেন না)
অতপর আমি ফিরে এসে ফাতেমা (রা.) কে জিজ্ঞাসা করলাম, মহিলাদের জন্য সর্বোত্তম বিষয় কোনটি? তিনি বললেন, কোনো পরপুরুষ তাকে দেখবে না অর্থাৎ নারী পর্দাবৃত থাকবে। তারপর আমি ঐ বিষয়টি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট উল্লেখ করলাম। তিনি বললেন, নিশ্চয় ফাতেমা আমার অংশ, সে সত্য বলেছে। (মুসনাদুল বাযযার: ৫২৬)
এতে পর্দার গুরুত্ব পরিস্ফূটিত হয়। আর পারিপার্শ্বিকতার বিবেচনায় বিবেকের দাবীও তাই। এছাড়াও পর্দা পালনের মাধ্যমে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় ও সম্মানিত হতে পারে। কেননা হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা পর্দানশীনদের ভালোবাসেন। আর কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন ও সম্মানিত যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন।’ (সূরা হুজুরাত: ১৩)
প্রকৃত অর্থে তাকওয়া সম্পন্ন বা মুত্তাকী হলো ঐ ব্যক্তি যে আল্লাহর নির্দেশসমূহ মেনে চলে। আর সর্বসম্মতিক্রমে পর্দা আল্লাহর সুস্পষ্ট নির্দেশ। যেহেতু পর্দা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য অবশ্য পালনীয় নির্দেশ সেহেতু পর্দা পালনের মাধ্যমে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত ও মর্যাদা সম্পন্ন হতে পারে।
এছাড়াও পর্দা-বিধান সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করলে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, এ বিধানের পূর্ণ অনুসরণের মাধ্যমে নারী ও পুরুষের নৈতিক চরিত্রের হিফাযত হয়। পারিবারিক ব্যবস্থা সুরক্ষিত ও সুদৃঢ় হয়। কারণ, পর্দা পালনের কারণে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে পরকিয়াবিহীন পবিত্র জীবন গঠিত হয় এবং চরিত্রহীনতা ও অবিশ্বাস তাদের থেকে বিদায় নেয়। তাই মুসলিম উম্মাহ অকপটে স্বীকার করতে বাধ্য যে, দুনিয়া ও আখিরাতে পর্দার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
মূলত পর্দাহীনতার কারণে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, নির্লজ্জতা, অপকর্ম ও ব্যভিচারের মতো নিকৃষ্ট পাপের সূচনা হয়। যার কারণে ইভটিজিং, ধর্ষণ ও যৌন সন্ত্রাস প্রকট আকার ধারণ করে। ফলে নানা অঘটনসহ ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন বিপর্যস্ত হয়। যার বাস্তব চিত্র নিত্যদিনের সংবাদপত্র খুললেই চোখে পড়ে।
এছাড়াও পর্দাহীনতার কারণে পরকিয়া ও চরিত্রহীনতার মতো ঘৃণিত কর্মের সূত্রপাত হয়। যার ফলে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস উঠে যায়। এতে পরিবারে অশান্তি ও বিপর্যয় নেমে আসে। যার বাস্তবতা আজ আমাদের নখদর্পণে। মূলত পর্দাহীন নারীরা হচ্ছে জগতের সবচেয়ে নিকৃষ্ট নারী। তাদের ব্যাপারে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে সবচে নিকৃষ্ট তারাই যারা পর্দাহীনভাবে চলাফেরা করে। (বায়হাকী: ১৩২৫৬)
তাই আমরা বলতে পারি যে, সুসভ্য ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী নারী কিছুতেই পর্দাহীন হতে পারে না। এমনকী অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে রসূলুল্লাহ (রা.) তাদেরকে লা’নত দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করিম (সা.) লা’নত অর্থাৎ অভিশাপ দিয়েছেন সেসব নারীদেরকে যারা পুরুষের বেশ ধারণ করে। অর্থাৎ পর্দাহীনভাবে চলাফেরা করে। (আবু দাউদ: ৪০৯৭)
এছাড়াও পর্দাহীনতার কারণে আল্লাহর বিধানকে অমান্য করা হয়। আর এ অবাধ্যতার কারণে আখিরাতে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। এ প্রসঙ্গে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, দুই শ্রেণীর জাহান্নামীদেরকে আমি দেখিনি অর্থাৎ পরবর্তী সময়ে সমাজে তাদের দেখা যাবে। এক. এমন সম্প্রদায়, যাদের হাতে গরুর লেজের মত চাবুক থাকবে, আর সেই চাবুক দিয়ে তারা অন্যায়ভাবে মানুষকে প্রহার করবে। দুই. এমন নারী, যারা পোশাক পরিধান করা সত্ত্বেও নগ্ন। তারা অন্যদেরকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করে এবং নিজেরাও অন্যদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাদের মাথা হবে উটের হেলে পড়া কুঁজের মতো। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, এমনকি জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না, অথচ জান্নাতের সুঘ্রাণ অনেক অনেক দূর থেকেও পাওয়া যায়। (মুসলিম: ৫৪৪৫)
এ হাদীসে মূলত পর্দাহীনতার ভয়াবহ পরিণতির প্রতি ইঙ্গিত করেই বলা হয়েছে যে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না এমনকী জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। এ বিষয়টি অন্যত্র আরো স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা) বর্ণনা করেন রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তিন শ্রেণীর লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এক. পিতা-মাতার অবাধ্যকারী। দুই. দাইয়ুস অর্থাৎ এমন পুরুষ, যে তার অধীনস্ত নারীদেরকে পর্দায় রাখে না। তিন. পুরুষের ন্যায় চলাফেরা করা নারী অর্থাৎ বেপর্দা নারী। (মুসতাদরাকুল হাকিম: ২৪৪)
এ হাদীস থেকে পর্দাহীনতার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে জানা যায় যে, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি। তাই জান্নাত প্রত্যাশী কোনো নারী কিছুতেই পর্দাহীন হতে পারে না। এ হাদীস থেকে আরো জানা যায় যে, যেসব পুরুষ তাদের অধীনস্ত নারীদের পর্দায় রাখার চেষ্টা করে না, তাদের জন্যও অনুরূপ পরিণতি।
একজন নারীর পর্দা পালনের তিনটি পর্যায় রয়েছে। যথা- গৃহে অবস্থানকালীন পর্দা, বাইরে গমনকালীন পর্দা এবং বৃদ্ধা অবস্থায় পর্দা। কোরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা অনুযায়ী প্রত্যেকটি পর্যায়ে পর্দা রক্ষা করে চলতে হবে। সামনে পর্দার তিনটি পর্যায় সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনা করা হল।
নারীর প্রধান আবাসস্থল হলো তার গৃহ। সাধারণত গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করা নারীর জন্য শোভনীয়। এ জন্য আল্লাহ তায়ালা নারীদেরকে তাদের গৃহাভ্যন্তরে অবস্থানের নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তোমরা তোমাদের গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করো, প্রাচীন জাহেলী যুগের নারীদের ন্যায় নিজেদেরকে প্রর্দশন করো না। (সূরা আহযাব: ৩৩)
আল্লামা ইবনে কাসীর (রহ.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, নারীর প্রকৃত অবস্থানক্ষেত্র হচ্ছে তার গৃহ। নারী প্রয়োজন ব্যতীত গৃহের বাইরে যাবে না বরং গৃহেই অবস্থান করবে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর: ৬/৪০৯)
মূলত নারী নিজেকে যত সংযত ও আবৃত রাখে আল্লাহ তায়ালার কাছে সে ততোই প্রিয় হয়ে ওঠে। ইসলামের দৃষ্টিতে তার মর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব ততোই উচ্চতর হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, নারী তার পালনকর্তার সর্বাদিক নিকটে তখনই থাকে যখন সে তার গৃহে অবস্থান করে। (সহীহ ইবনে হিব্বান: ৫৫৯৯)
তাই মু’মিন নারীদের উচিত গৃহাভ্যন্তরে এমনভাবে অবস্থান করা যাতে আত্মীয় বা অনাত্মীয় কোনো গায়রে মাহরাম বা পরপুরুষের দৃষ্টিতে সে না পড়ে। আর এভাবে গৃহে অবস্থান করার মাধ্যমেই পর্দার যথার্থতা অর্জিত হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, যখন তোমরা তাদের (নবী পত্মীদের) কাছে কিছু চাইবে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এ বিধান তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কারণ। (সূরা আহযাব: ৫৩)
এ আয়াতে বিশেষভাবে নবী-পত্মীদের কথা উল্লেখ থাকলেও এ বিধান সমগ্র উম্মতের জন্য ব্যাপকভাবে প্রযোজ্য। এ বিধানের সারমর্ম এই যে, নারীদের কাছ থেকে ভিন্ন পুরুষদের কোনো ব্যবহারিক বস্তু, পাত্র, বস্ত্র ইত্যাদি নেয়া জরুরী হলে সামনে এসে নেবে না, বরং পর্দার আড়াল থেকে চেয়ে নিবে।
এ নির্দেশনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, নারীরা তাদের গৃহে অবস্থানকালীন মুহুর্তেও গায়রে মাহরাম বা পরপুরুষ, নিকটাত্মীয় হোক বা দূরাত্মীয় সকলের কাছ থেকে সম্পূর্ণ পর্দার আড়ালে অবস্থান করবে। তবে প্রয়োজন হলে পর্দার আড়াল থেকেই কথা বলবে। আর পরপুরুষরাও পর্দার আড়াল থেকেই কথা বলতে হবে। এতে পর্দার অপরিহার্যতা পরিস্ফূটিত হয়।
আয়াতের শেষাংশে পর্দার গুরুত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, পর্দার এ বিধান পুরুষ ও নারী উভয়ের অন্তরকে মানসিক কুমন্ত্রণা থেকে পবিত্র রাখার উদ্দেশ্যে দেয়া হয়েছে। এখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয় এই যে, এস্থলে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর পুণ্যাত্মা পত্মীদেরকে পর্দার বিধান দেয়া হয়েছে, যাদের অন্তরকে পবিত্র রাখার দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা গ্রহণ করেছেন।
অপরদিকে যেসব পুরুষকে সম্বোধন করে এই বিধান দেয়া হয়েছে, তারা হলেন রাসূলে করীম (সা.) এর সাহাবায়ে কিরাম, যাদের মধ্যে অনেকের মর্যাদা ফেরেশতাগণেরও উর্ধ্বে। কিন্তু এসব বিষয় সত্ত্বেও তাদের আন্তরিক পবিত্রতা ও মানসিক কুমন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য পুরুষ ও নারীর মধ্যে পর্দার ব্যবস্থা করা জরুরী মনে করা হয়েছে।
আজ এমন ব্যক্তি কে, যে তার মনকে সাহাবায়ে কিরামের পবিত্র মন অপেক্ষা এবং তার স্ত্রীর মনকে পুণ্যাত্মা নবী-পত্মীদের মন অপেক্ষা অধিক পবিত্র হওয়ার দাবি করতে পারে। আর এটা মনে করতে পারে যে, নারীদের সাথে তাদের মেলামেশা কোন অনিষ্টের কারণ হবে না! (তাফসীরে মা’আরেফুল কুরআন: ৭/১৯৫)
বহু বিশুদ্ধ হাদীস থেকেও প্রতিভাত হয় যে, উম্মাহাতুল মু’মিনীন বা নবীপত্মীরা সাধারণত তাদের গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করার মাধ্যমেই পর্দা পালন করতেন। আল্লাহ তায়ালা মু’মিন নারীদেরকেও অনুরূপভাবে পর্দা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা বলেন, “হে নবী মু’মিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে। আর তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে তবে যা সাধারণত অনিচ্ছা সত্ত্বে প্রকাশিত হয়ে যায় তা ভিন্ন। তারা যেন ওড়না দিয়ে তাদের বক্ষকে আবৃত করে রাখে। আর তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, আপন নারীগণ, তাদের মালিকানাধীন দাসী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ এবং নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ বালক ছাড়া অন্য কারো কাছে নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। আর তারা যেন তাদের গোপন সাজ্জসজ্জা প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে সজোরে পদচারণা না করে। হে মুমিনগণ, তোমরা সকলেই আল্লাহর নিকট তাওবা কর, যাতে তোমরা সফল হতে পার।“ (সূরা নূর: ৩১)
এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, নারীরা মাহরাম পুরুষ অর্থাৎ এমন পুরুষ যাদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া হারাম বা নিষিদ্ধ, তারা ব্যতীত অন্য কোনো পুরুষের সামনে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ করতে পারবে না। এতে পর্দার অপরিহার্যতা প্রমাণিত হয়। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “তোমরা নারীদের নিকট যাওয়া থেকে বিরত থাক। তখন এক আনসার সাহাবী বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! দেবরের ব্যাপারে আপনার অভিমত কি? তিনি বললেন, দেবর হচ্ছে মৃত্যুতুল্য।“ (বুখারী: ৫২৩২)
আলোচ্য হাদীসে ব্যবহৃত ‘হামউ’ শব্দের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে স্বামীর নিকটাত্মীয়। শব্দটির উদ্দেশ্য ব্যাপক। শব্দটি দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, স্বামীর যেকোনো দিকের ভাই, চাচা, মামা, খালু, ফুফা এবং তাদের প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে সন্তান। যেমন: দেবর, ভাসুর, চাচা শ্বশুর, মামা শ্বশুর, তাদের প্রত্যেকের ছেলে সন্তান ইত্যাদি।
ইমাম তিরমিযী, লাইস ইবনু সা’দ, আল্লামা কাযী ইয়ায ও তাবারী সহ বহু আলেম অনুরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। অর্থাৎ নারীর জন্য তার দেবর, ভাসুর, চাচা শ্বশুর, মামা শ্বশুর ও তাদের ছেলেদের সামনে নিজেকে প্রদর্শন করা থেকে দূরে থাকতে হবে যেভাবে মৃত্যু থেকে দূরে থাকতে চায়।
আর এ ব্যাপারে সর্বোপরি কথা হলো, নারীরা তাদের গৃহে অবস্থানকালীন মুহুর্তে মাহরাম নয় এমন সকল পুরুষ থেকে পূর্ণ পর্দা রক্ষা করে চলবে। অর্থাৎ নারীরা এমনভাবে গৃহে অবস্থান করবে যাতে নিকটাত্মীয় বা দূরাত্মীয় কোনো গায়রে মাহরাম বা বেগানা পুরুষের নজরে সে না পড়ে। গৃহে অবস্থানকালীন মুহুর্তে এভাবে পর্দাবৃত থাকা নারীর জন্য অপরিহার্য।
বলা বাহুল্য যে, নারীদের জন্য গৃহের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী। এজন্য ইসলাম প্রয়োজনে নারীকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সা.) তার স্ত্রী হযরত সাওদা (রা.) কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘প্রয়োজনে তোমাদেরকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে।‘ (বুখারী: ৪৭৯৫)
মূলত ইসলাম একটি সর্বাঙ্গীন ও পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। তাই মানব প্রয়োজনের সকল দিকই ইসলামে বিবেচিত হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে পর্দাবৃত হয়েই বাইরে বের হতে হবে। কিছুতেই পর্দাহীনভাবে বের হওয়া যাবে না। এ প্রসঙ্গে বিশ্বনবী (সা.) বলেন, “নারী পর্দাবৃত থাকার বস্তু, যখনই সে পর্দাহীনভাবে বের হয় তখন শয়তান তার দিকে উঁকি মেরে তাকায়।“ (তিরমিযী: ১১৭৩)
আর পবিত্র কোরআনে নারীদেরকে বাইরে গমনকালীন মুহুর্তে পূর্ণ পর্দা পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালার সুস্পষ্ট নির্দেশ, ‘হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রী, কন্যা এবং মু’মিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন প্রয়োজনে বাইরে যাওয়ার সময় তাদের পরিহিত জিলবাবের একাংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা আহযাব: ৫৯)
এ আয়াতে নারীদেরকে বাইরে গমনের সময় তাদের পরিহিত জিলবাবের একাংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন, জিলবাব হলো নারীর এমন পোশাক যা দিয়ে তারা পুরো দেহ ঢেকে রাখে। অর্থাৎ বাইরে গমনের সময় দেহের সাধারণ পোশাক- জামা, পাজামা, ওড়না ইত্যাদির উপর আলাদা যে পোশাক পরিধান করার মাধ্যমে নারীর আপাদমস্তক আবৃত করা যায় তাকে জিলবাব বলা হয়। আমাদের দেশে যা বোরকা নামে পরিচিত।
এ থেকে বুঝা যায় যে, বাইরে গমনের সময় বোরকা পরিধান করে আপাদমস্তক আবৃত করে বের হওয়া আবশ্যক। আর আয়াতে জিলবাবের একাংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়ার যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মাথা ও মুখমণ্ডল ঢেকে নেয়া। যা সাহাবী, তাবেয়ী ও নির্ভরযোগ্য মুফাসসিরদের তাফসীর থেকে প্রতিভাত হয়।
এ প্রসঙ্গে আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা এ আয়াতে মুমিন নারীদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, প্রয়োজনে তারা যখন বাইরে যাবে তখন তারা যেন জিলবাব দিয়ে পুরো দেহ আবৃত করার পর তাদের মাথার উপর দিক থেকে তাদের মুখমণ্ডলও আবৃত করে নেয়। তবে তারা চলাফেরার সুবিধার্থে একটি চোখ খোলা রাখবে। (ইবনে কাসীর: ৬/৪৮২)
প্রখ্যাত তাবেয়ী মুহাম্মদ ইবনে সিরীন (রহ.) বলেন, আমি আবীদাহ সালামানীহকে এ আয়াতের ব্যাখ্যা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম তখন তিনি তার মাথা ও মুখমণ্ডল ঢেকে নিলেন। অর্থাৎ তিনি বুঝিয়েছেন যে, এ আয়াতে পুরো দেহ আবৃত করার পর মাথা ও মুখমণ্ডল ঢেকে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। (ইবনে কাসীর: ৬/৪৮২)
সাহাবী ও তাবেয়ীগণের পরবর্তী মুফাসসিরদের ব্যাখ্যার দিকে তাকালেও দেখা যায় যে, ইবনে জারীর তাবারী, ইবনে কাসীর, বায়যাবী, বাগভী, নাসাফী, সুয়ূতি, আবু বকর জাসসাস, মুফতি মুহাম্মদ শফিসহ সব তাফসীরকারকগণ এ আয়াতের অনুরূপ ব্যাখ্যাই করেছেন। অর্থাৎ সকলে একমত পোষণ করেছেন যে, এ আয়াতে নারীদেরকে তাদের চেহারাসহ আপাদমস্তক আবৃত করে বের হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে বাইরে গমনকালীন পর্দার অপরিহার্যতা প্রমাণিত হয়।
আর এ ব্যাপারে সর্বোপরি কথা হলো, কোনো প্রয়োজনে নারীকে বাইরে যেতে হলে তখন তার জন্য আবশ্যক হচ্ছে চেহারাসহ গোটা দেহ আবৃত করে পূর্ণ পর্দার সঙ্গে বের হওয়া। যা সর্বসম্মতিক্রমে ফরয। এক্ষেত্রে জিলবাব বা বোরকা পরিধানের মাধ্যমে আপাদমস্তক আবৃত করে নিবে। প্রয়োজনে চেহারা বা মুখমণ্ডলের জন্য আলাদা নিকাব ব্যবহার করবে। আর হাতের কব্জি ও পায়ের গোড়ালীর জন্য মোজা পরিধান করবে। তবে চলাফেরার সুবিধার্থে রাস্তা-ঘাট দেখার জন্য শুধু চোখ খোলা রাখবে।
বয়স্ক নারীদের জন্য পর্দা পালনের ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা গ্রহণেন অবকাশ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অতিশয় বৃদ্ধা নারী, যারা বিবাহের আশা রাখে না, তাদের জন্য অপরাধ নেই, যদি তারা তাদের সৌর্ন্দয প্রদর্শন না করে তাদের অতিরিক্ত বস্ত্র খুলে রাখে। তবে এ থেকে বিরত থাকাই তাদের জন্য উত্তম। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা নূর: ৬০)
আয়াতের নির্দেশনা হল, যে বৃদ্ধা নারীর প্রতি কেউ আকর্ষণ বোধ করে না এবং সে বিবাহেরও যোগ্য নয় তার জন্য পর্দার বিধান শিথিল করা হয়েছে। গায়রে মাহরাম ব্যক্তিও তার কাছে মাহরামমের ন্যায় হয়ে যায়। মাহরামদের কাছে যেসব অঙ্গ আবৃত করা জরুরী নয়। বৃদ্ধা নারীদের জন্য গায়রে মাহরাম পুরুষদের কাছেও সেগুলো আবৃত করা জরুরী নয়। এরূপ বৃদ্ধা নারীর জন্য বলা হয়েছে, মাহরাম পুরুষদের সামনে যেসব অঙ্গ খুলতে পারবে, গায়রে মাহরাম পুরুষদের সামনেও সেগুলো খুলতে পারবে। (তাফসীরে মা’আরেফুল কুরআন: ৬/৪৩৯)
এ ব্যাপারে সর্বোপরি কথা হলো, চরম বার্ধক্যে পৌঁছার কারণে যেসকল নারী বিবাহের উপযুক্ত নয় এবং যাদের প্রতি কারো আকর্ষণ সৃষ্টি হয় না, এ ধরনের বৃদ্ধা নারীর জন্যই এ বিধান। তাদেরকে এই সুবিধা দেয়া হয়েছে যে, গায়রে মাহরাম পুরুষের সামনে অন্যান্য নারীদেরকে যেমন আপাদমস্তক ঢেকে রাখতে হয়, তাদের জন্য তা জরুরী নয়। এ রকম বৃদ্ধা নারীগণ তা ছাড়াই পরপুরুষের সামনে যেতে পারবে। তবে শর্ত হল, তারা তাদের সামনে সেজেগুঁজে যেতে পারবে না। এর সঙ্গে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে বিধানের এ শিথিলতা কেবলই জায়েয পর্যায়ের।
সুতরাং তারা যদি বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করে এবং অন্যান্য নারীদের মত তারাও পরপুরুষের সামনে পুরোপুরি পর্দা রক্ষা করে চলে তবে সেটাই তাদের জন্য উত্তম। (তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন: ২/৪৬৮)
এ বিধানের ব্যাপারে সারকথা হলো, কোরআন-সুন্নাহর আলোকে সর্বসম্মতিক্রমে হিজাব বা পর্দা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নারী জাতির জন্য এক ফরয বিধান। সর্বাবস্থায় এ বিধানের প্রতি পূর্ণ সমর্পিত থাকা অপরিহার্য। তবে চিকিৎসা ইত্যাদি বিশেষ প্রয়োজনের ক্ষেত্রে প্রয়োজন মাফিক শিথিলতা গ্রহণের অবকাশও অবশ্যই রয়েছে।
আচ্ছা নারীবাদীরা যে নারী স্বাধীনতার কথা বলে নারীদের বস্ত্রহীন করতেছে কোন যুক্তিতে! আর বাংলাদেশের বেশিরভাগ নারী শালীন পোষাক পরিধান করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কিছু নারীবাদী বাঙালিত্বের দোহাই দিয়ে বলে 'আমরা বাঙালি হয়ে আরবীয় পোষাক কেন পড়ব!' নারীবাদীদের আমি বলতে চাই 'তুমি বাঙালি নারী হয়ে ইউরোপ-আমেরিকান পোষাক কেন পড়তে চাও!'
যেসব নারী বা পুরুষেরা শালীন পোষাকের বিরোদ্ধে শ্লোগান তুলে তারা নিজেরাই নিজের ধর্মের বিরোধিতা করে। কারণ, প্রত্যেক ধর্মেই পর্দা রক্ষার কথা বলা হয়েছে।
শিয়াল চায় মুরগি বের হয়ে আসুক।
মাছি চায় মিষ্টির প্যাকেট খোলা থাকুক।
যেসব পুরুষ নারীদের খোলামেলা পোষাকের সাপোর্ট করে তাদের কাছে প্রশ্ন, আপনি কি চান আপনার মা-বোনের উন্মুক্ত শরীরের দিকে কোনো পুরুষ ড্যাব ড্যাব করে লুতুপুতু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকুক! নিজের বেলায় ষোল আনা অন্যের বেলায় ঠনঠনা। দুমুখো নীতি কেন ভাই!
শালীন পোষাকে একজন নারীকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগে। আর শালীন পোষাকে একজন নারীর সম্মান বৃদ্ধি পায়।
শুধু শালীন পোষাক পড়লেই হবেনা, পাশাপাশি অন্তরে শালীনতাও থাকতে হবে। কুরআনে বলা হয়েছে, 'হে আদম সন্তানেরা! আমি তোমাদের বস্ত্র দিয়েছি তোমাদের শরীর ঢাকার বস্ত্র হিসাবে এবং একই সাথে সৌন্দর্য প্রকাশের জন্য। কিন্তু এর মধ্যে তাকওয়ার পোষাকই উত্তম।
[আল আরাফঃ ২৭]
খুব সুন্দর লেখা। সত্যি অসাধারণ।
ReplyDelete