বাংলার প্রাচীন খাদ্যাভ্যাস: ইতিহাসের পাতায় হারানো স্বাদ

বাংলার প্রাচীন খাদ্যাভ্যাস: ইতিহাসের পাতায় হারানো স্বাদ

লিখেছেন: তৌহিদ রাসেল





"তোমার খাদ্যই তোমার পরিচয়"—এই কথাটির বাস্তবতা বাংলার প্রাচীন খাদ্যাভ্যাসে গভীরভাবে প্রতিফলিত। বাঙালির খাবার কেবল রুচির নয়, বরং জীবনযাপন, ধর্ম, সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতির প্রতিচ্ছবি। আজ আমরা যে খাবারকে বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বিবেচনা করি, তার অনেকটাই মূলত ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফসল। এই প্রবন্ধে আমরা ফিরে তাকাব বাংলার সেই অতীত সময়ে—যখন রান্না মানে ছিল প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা, এবং খাদ্য মানে ছিল আত্মার তৃপ্তি।


১. প্রাচীন বাংলার আমিষ খাদ্য

গরুর মাংস: বিতর্কের অতীত এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা

বাংলার ইতিহাসে গরুর মাংস খাওয়ার রীতি নিয়ে রয়েছে বিস্তর বিতর্ক। তবে ইতিহাসবিদদের লেখায় ও বৈদিক সাহিত্যে স্পষ্ট প্রমাণ মেলে যে প্রাচীন যুগে গোমাংস ছিল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য খাদ্য।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা তাঁর আলোচিত গ্রন্থ The Myth of the Holy Cow-এ লেখেন:

“The cow was not inviolable in ancient India. Vedic texts suggest the slaughter of cows for rituals and feasts was common.”
অর্থাৎ গরু ছিল না কোনো ‘অস্পর্শনীয়’ প্রাণী, বরং যজ্ঞ ও অতিথি আপ্যায়নে তার মাংস ব্যবহৃত হতো।

ঋগ্বেদ-এ “গোমেধ” নামক যজ্ঞের বর্ণনা আছে, যেখানে গরু বলি দেওয়া হতো। শতপথ ব্রাহ্মণ গ্রন্থেও পাওয়া যায় গরুর মাংস রান্না করে অতিথিকে পরিবেশনের কথা।

১১শ শতকের জ্ঞানী আল-বিরুনী তাঁর কিতাবুল হিন্দ গ্রন্থে বলেন:

“In earlier times, Hindus used to eat beef, but they later stopped and began revering the cow as sacred.”

এমনকি চাণক্য (কৌটিল্য) রচিত অর্থশাস্ত্র-এও গোমাংস বিক্রির উপর কর আরোপের নির্দেশ আছে।

নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙালির ইতিহাস-এ বলেন:

“বৈদিক ও প্রাক্‌-বৈদিক যুগে গরু ছিল সম্পদের প্রতীক হলেও, তার মাংস আহার্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য ছিল।”

অন্যান্য মাংস: বন ও জলাভূমির উপহার












প্রাচীন বাংলা ছিল নদীমাতৃক ও বনাঞ্চলপূর্ণ। তাই শিকারের মাংস ছিল সহজলভ্য ও জনপ্রিয় খাদ্য।

  • মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে বারবার ফিরে আসে শিকারি ও তাঁদের খাদ্যতালিকা—হরিণ, বনছাগল, শূকর, বনমোরগ, গুইসাপ, এমনকি কচ্ছপের মাংস।
  • ড. সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন তাঁর বাংলার প্রাচীন ইতিহাস-এ বলেন:

“নদী ও বনভূমির প্রাচুর্যে প্রাচীন বাঙালির আমিষ চাহিদা প্রাকৃতিক ভাবেই পূর্ণ হতো।"

মাছ: চিরন্তন বাঙালিয়ানার প্রতীক

প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ ও সাহিত্য বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায়, মাছ প্রাচীনকাল থেকেই ছিল বাঙালির খাবারের প্রধান অঙ্গ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন:

“জল এবং মাছ ছাড়া বাঙালিকে কল্পনা করাই কঠিন।”


২. নিরামিষ খাদ্য: প্রকৃতির দান ও কৃষির প্রতিচ্ছবি

ধান ও ডাল

বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজে ধান ছিল প্রধান খাদ্যশস্য। উয়ারি-বটেশ্বরমহাস্থানগড় প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাওয়া গেছে প্রাচীন ধানের দানা, মাটির মাড়া, চুলা ইত্যাদি।

নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন:

“ধান শুধু খাদ্য নয়, এটি ছিল গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড।”

ডালের মধ্যে মসুর, মুগ, কলাই প্রচলিত ছিল। বাঙালি রান্নায় ‘মুগডাল ভাজা’ ও ‘মসুর ডাল সেদ্ধ’ প্রাচীন কালের থেকেই পরিচিত।

তেল ও মসলা

সরিষা ও তিল থেকে তৈল উৎপাদন হতো। রান্নায় ব্যবহৃত হতো আদা, হলুদ, রসুন, ধনে, জিরে ইত্যাদি।

চৈতন্যচরিতামৃত-এ পাওয়া যায় এমন এক বর্ণনা:

“সাধুদের ভোগে নারকেল, মুগডাল, আদা, ঘি দিয়ে নিরামিষ খিচুড়ি পরিবেশিত হতো।”

ফল ও শাক-সবজি

বাংলার জলবায়ু ফলমূলের জন্য অনুকূল।

  • আম, কাঁঠাল, ডুমুর, কলা, জাম, তাল ছিল প্রচলিত ফল।
  • শাকসবজির মধ্যে পালং, কলমি, পুঁই, ঢেঁড়স, করলা, আলু, কচু প্রাচীন সময় থেকেই ব্যবহৃত।

৩. রান্না ও সামাজিকতা: এক সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ

রান্নার সরঞ্জাম ও পদ্ধতি

প্রাচীন বাংলায় রান্না হতো মাটির হাঁড়ি ও কাঠের চুলায়।

  • উয়ারি-বটেশ্বর খননে পাওয়া গেছে কুমোর হুইল ও মাটির হাঁড়ি।
  • রান্না করতেন সাধারণত নারীরা, তবে উৎসবে পুরুষরাও অংশ নিতেন।

উৎসব, পার্বণ ও খাবার

  • গরুর মাংস রান্না হতো বিয়েতে, পিঠা-পার্বণে বা মরদেহ শ্রাদ্ধে।
  • মাছ-ভাত ছিল নবান্নের প্রধান খাবার।
  • পায়েস, খিচুড়ি, পিঠা—উৎসবের অন্যতম অংশ ছিল।

মুহম্মদ হাবিবুর রহমান (বাংলার খাদ্য সংস্কৃতি) বলেন:

“উৎসব মানেই ছিল বিশেষ রান্নার আয়োজন, আর তা ঘিরেই তৈরি হতো সামাজিক সংহতি।”

খাদ্য ও জাতপাত

প্রাচীনকালে জাত-পাত অনুসারে খাদ্যের নিয়ম ছিল আলাদা। ব্রাহ্মণদের জন্য নিরামিষ বাধ্যতামূলক হলেও, অন্যান্য জাতির মধ্যে আমিষ প্রচলিত ছিল।


প্রাচীন বাংলার খাদ্যাভ্যাস ছিল বৈচিত্র্যময়, যুক্তিগ্রাহ্য ও প্রকৃতিনির্ভর। আজ যেসব খাবারকে আমরা ‘হারাম’ বা ‘অবৈধ’ ভাবি, সেগুলোর অনেকই একসময় ছিল সমাজে গ্রহণযোগ্য।

“ইতিহাস শুধু অতীত নয়, এটি বর্তমানের আয়না ও ভবিষ্যতের দিশারি।”

আজকের বাংলাদেশে খাদ্য নিয়ে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিতর্ক চললেও, ইতিহাস আমাদের শেখায়—সহিষ্ণুতা, বৈচিত্র্য ও বাস্তবতার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতি। গোমাংস থেকে শুরু করে বনফল, নদীর মাছ থেকে মাঠের ধান—সবই ছিল আমাদের অতীত জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।


তথ্যসূত্র

১. দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা, The Myth of the Holy Cow
২. আল-বিরুনী, কিতাবুল হিন্দ (অনুবাদ)
৩. ড. সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন, বাংলার প্রাচীন ইতিহাস
৪. মুহম্মদ হাবিবুর রহমান, বাংলার খাদ্য সংস্কৃতি
৫. নীহাররঞ্জন রায়, বাঙালির ইতিহাস
৬. মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, চণ্ডীমঙ্গল
৭. কৃষ্ণদাস কবিরাজ, চৈতন্যচরিতামৃত
৮. প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর প্রতিবেদন, উয়ারি-বটেশ্বর খনন
৯. হিউয়েন সাঙ, ভারত ভ্রমণ বিবরণী


Comments

Popular posts from this blog

সমকাম বা হোমোসেক্সুয়াল

বিভিন্ন ধর্মে নারীর পর্দা- তৌহিদ রাসেল

এক নজরে দোহার উপজেলা