ইসলামে বকাবাজি, নিন্দা, অপবাদ, কুৎসা ও ভুল তথ্য সম্পর্কে আলোচনা - তৌহিদ রাসেল

 


ইসলাম শান্তি, সত্যবাদিতা ও ন্যায়বিচারের শিক্ষা দেয়। কারো বিরুদ্ধে বকাবাজি, নিন্দা, অপবাদ, কুৎসা রচনা এবং ভুল তথ্য প্রচার করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কুরআন ও হাদিসে এই বিষয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে।


১. গিবত (পরনিন্দা) ও বকাবাজি সম্পর্কে কুরআনের বাণী

(ক) পরনিন্দা করা মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার সমতুল্য

আল্লাহ বলেন:

"হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিক সন্দেহ পরিহার কর, কারণ কোনো কোনো সন্দেহ তো গুনাহ। আর পরস্পরের গিবত (পরনিন্দা) করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের মাংস খেতে পছন্দ করবে? অথচ তোমরা তো একে ঘৃণা করো। আল্লাহকে ভয় করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।"
(সূরা আল-হুজুরাত: ১২)

এ আয়াতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষ চর্চা করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

(খ) মিথ্যা ও কুৎসা রচনা সম্পর্কে সতর্কতা

আল্লাহ বলেন:

"যারা মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের কষ্ট দেয় এমন কাজের জন্য, যা তারা করেনি, নিশ্চয়ই তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করছে।"
(সূরা আল-আহযাব: ৫৮)

কাউকে অন্যায়ভাবে দোষী সাব্যস্ত করা বা কুৎসা রচনা করা একটি বড় গুনাহ।


২. অপবাদ, মিথ্যা ও গুজব রটানো সম্পর্কে কুরআনের সতর্কতা

(ক) অপবাদ দিলে কঠোর শাস্তি

"যারা পবিত্র নারীদের অপবাদ দেয়, অতঃপর চারজন সাক্ষী উপস্থিত করতে পারে না, তাদের ৮০ দোররা মারো এবং কখনো তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করো না। আর তারাই ফাসিক।"
(সূরা আন-নূর: ৪)

এই আয়াতে ইসলামে অপবাদ রটানোর ভয়াবহ পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে।

(খ) গুজব রটানো সমাজ ধ্বংসের কারণ

"যখন তোমরা একে (অপবাদ) শুনলে তখন কেন মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা নিজেদের সম্পর্কে ভালো ধারণা করল না এবং বলল না: এটি তো স্পষ্ট মিথ্যা?"
(সূরা আন-নূর: ১২)

এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, কোনো খবর যাচাই-বাছাই না করে বিশ্বাস করা এবং প্রচার করা কঠোরভাবে নিষেধ।


৩. হাদিসের আলোকে পরনিন্দা ও মিথ্যা প্রচারের পরিণাম

(ক) গিবত (পরনিন্দা) সম্পর্কে কঠোর হাদিস

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

"তুমি কি জানো গিবত কী?"
সাহাবিরা বললেন, "আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভালো জানেন।"
তিনি বললেন, "গিবত হলো তোমার ভাইয়ের সম্পর্কে এমন কিছু বলা, যা সে অপছন্দ করে।"
সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, "আমরা যদি সত্য কথাই বলি?"
তিনি বললেন, "যদি সে ত্রুটি সত্য হয়, তবে সেটিই গিবত; আর যদি মিথ্যা হয়, তবে তা অপবাদ।"
(সহিহ মুসলিম: ২৫৮৯)

(খ) মিথ্যা বলা ও গুজব ছড়ানোর শাস্তি

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

"যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও কাজ করা পরিত্যাগ করে না, তার পানাহার ও রোজা রাখার আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।"
(সহিহ বুখারি: ১৯০৩)

এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, শুধু রোজা রাখা বা ইবাদত করাই যথেষ্ট নয়, বরং মিথ্যা ও গিবত থেকে বেঁচে থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

(গ) জাহান্নামে গিবতকারীর শাস্তি

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

"আমি মেরাজ রাতে এক শ্রেণির মানুষ দেখলাম, যারা নিজেদের নখ দিয়ে নিজেদের মুখমণ্ডল ও বুক আঁচড়াচ্ছে। আমি জিব্রাইল (আ.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, 'এরা কারা?' তিনি বললেন, 'এরা তারা, যারা মানুষের গিবত করত এবং তাদের সম্মান নষ্ট করত।'"
(সুনানে আবু দাউদ: ৪৮৭৮)


৪. কিভাবে বকাবাজি, নিন্দা ও অপবাদ থেকে বাঁচা যায়?

(ক) নিজের মুখের নিয়ন্ত্রণ করা

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

"যে ব্যক্তি তার জিহ্বা ও গোপনাঙ্গকে সংযত রাখার নিশ্চয়তা দেবে, আমি তার জন্য জান্নাতের নিশ্চয়তা দেব।"
(সহিহ বুখারি: ৬৪৭৪)

(খ) অপরের ভুল গোপন করা

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

"যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষ গোপন করবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ গোপন করবেন।"
(সহিহ মুসলিম: ২৫৯০)

(গ) সত্য যাচাই করা

কুরআনে বলা হয়েছে:

"হে ঈমানদারগণ! যদি কোনো ফাসিক তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে যাচাই করে দেখো, যাতে তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনো সম্প্রদায়কে আঘাত না করো এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও।"
(সূরা আল-হুজুরাত: ৬) 

এক ব্যক্তি নিয়মিতভাবে আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.)-এর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা ও অপবাদ দিত। যখন এই বিষয়ে তাকে জানানো হলো, তখন তিনি আশ্চর্য হলেন না, বরং স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করলেন। এরপর তিনি সেই ব্যক্তির কাছে একটি থলে ভর্তি উপহার পাঠালেন এবং একটি চিঠিতে লিখলেন:

"আমি শুনেছি, আপনি আপনার নেক আমল আমাকে উপহার দিয়েছেন। এজন্য আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এবং বিনিময়ে আপনাকে এই উপহার পাঠালাম। তবে দয়া করে এটি চালিয়ে যান, যেন আমি আরও বেশি সওয়াব লাভ করতে পারি।"

এই ঘটনার শিক্ষা:

  • গিবত ও অপবাদ অন্যের সওয়াব বাড়িয়ে দেয়: কেউ যদি অন্য কারও গিবত বা অপবাদ দেয়, তবে সে তার নেক আমল হারায় এবং যাকে নিয়ে গিবত করা হয়েছে, সে সেই আমল লাভ করে।
  • ধৈর্য ও উদারতা: আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.)-এর মতো মনোভাব একজন মুসলিমের চরিত্রকে উন্নত করে এবং পার্থিব দুশ্চিন্তা কমায়।
  • বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নিন্দুকদের জবাব: উত্তপ্ত প্রতিক্রিয়া দেখানোর পরিবর্তে, তিনি কৌশলে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, অন্যের কুৎসা রটনা আসলে তারই উপকার করছে।

সংশ্লিষ্ট হাদিস:

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

"যে ব্যক্তি অন্যের গিবত করে, সে তার নেক আমল সেই ব্যক্তিকে দিয়ে দেয়, যার বিরুদ্ধে সে গিবত করেছে।"
(মুসনাদে আহমাদ: ২০০৯৯, সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।)

এই ঘটনাটি আমাদের শেখায় যে, গিবত ও অপবাদ থেকে বিরত থাকা উচিত, কারণ এটি শুধু অন্যের ক্ষতি করে না, বরং নিজেদের আমলও ধ্বংস করে দেয়।


উপসংহার

ইসলামে বকাবাজি, নিন্দা, অপবাদ, কুৎসা ও ভুল তথ্য প্রচার করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ এবং এগুলোর শাস্তি অত্যন্ত ভয়াবহ। একজন প্রকৃত মুসলমানের উচিত সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকা, যাচাই-বাছাই ছাড়া কোনো কথা না বলা, এবং অপরের দোষ চর্চা না করা।

আল্লাহ আমাদের গিবত, মিথ্যা ও অপবাদ থেকে রক্ষা করুন। আমিন।


Comments

Popular posts from this blog

সমকাম বা হোমোসেক্সুয়াল

বিভিন্ন ধর্মে নারীর পর্দা- তৌহিদ রাসেল

এক নজরে দোহার উপজেলা