ট্রয় নগরী, প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ - তৌহিদ রাসেল

 

পৃথিবীর মানবসভ্যতার ইতিহাসে ভূমধ্যসাগর, ক্যাস্পিয়ান সাগর, ইজিয়ান সাগর এবং কৃষ্ণ সাগর বিশেষভাবে বিখ্যাত। কারণ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বড় মানবসভ্যতা ধ্বংস এগুলোর তীর থেকেই সূত্রপাত ঘটে। তাই শুরু করা যাক ইজিয়ান সাগরের এপারওপারের যত গল্প।


প্রাচীন পুরাণে উল্লেখিত বিখ্যাত নাম হেলেন। প্রাচীনকালের সে সময় হেলেনের রূপ-সৌন্দর্যে মুগ্ধ গ্রিসের হাজারো যুবক পাণিপ্রার্থী হতে থাকে হেলেনের। তাদের মাঝে মেনিলাস আবির্ভূত হন সৌভাগ্যবান হিসেবে। হেলেনের অমতেই বিয়ে দেয়া হয় মেনিলাসের সাথে। 


প্রাচীন গ্রিস সে সময় বিভিন্ন রাজ্যে বিভক্ত ছিল- স্পার্টা ও মাইসেনিয়া ছিল তন্মধ্যে অন্যতম। স্পার্টার রাজা ছিলেন মেনিলাস, আর মাইসেনিয়ার রাজা আগামেনন। মেনিলাস ও আগামেনন সম্পর্কে ছিলেন আপন ভাই। একাধিক স্ত্রী থাকা সত্বেও রাজা মেনিলাস হেলেনকে রানী হিসেবে পেতে পাগল হয়ে ওঠেন। প্রায় ৬০ জন প্রহরী নিয়ে হাজির হন দেবরাজ জিউসের রাজপ্রাসাদে। কোন কোন বর্ণনায়,ছোট ভাই মেনিলাসের হয়ে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন আগামেনন। কিন্তু পরবর্তীতে আগামেনন হেলেনকে বিয়ে করে ফেলেন।


যাইহোক, এ সময় ‘দ্য ট্রোজান প্রিন্স’ প্যারিসের আবির্ভাব ঘটে ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে। মিথোলজির সুবিখ্যাত এজিয়ান সাগরের ওপারের এক নগরী ছিলো ট্রয়। ইতিহাসের ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরীগুলোর মধ্যে যা অন্যতম। গ্রিক ভাষায় ট্রয় কে বলা হয় ‘ত্রইয়া’ বা ‘ইলিয়ন’। লাতিন ভাষায় ‘ত্রুইয়া’ বা ‘ইলিয়াম’। হিত্তীয় ভাষায় ‘উইলুসা’। ট্রয়ের তুর্কী নাম ‘ত্রুভা’ বা ‘ত্রয়া’। হোমারের ইলিয়াডে যে ট্রয়ের উল্লেখ রয়েছে সেটিকেই এখন ট্রয় নামে আখ্যায়িত করা হয়। এর অবস্থান আনাতোলিয়া অঞ্চলের হিসারলিক নামক স্থানে। অর্থাৎ, আধুনিক হিসারলিক-ই সেই প্রাচীন ট্রয় নগরী ।


ব্যবসায়ীর কাজে বড় ভাই হেক্টর ও প্যারিস এজিয়ান সাগর পাড়ি দেবে। বোন ক্যাসান্ড্রা তাকে সতর্ক করল এবং অনুনয় করে বলল, এ যাত্রা ট্রোজানদের জন্য দুঃখ বয়ে আনবে। বোনের কথা অগ্রাহ্য করে খ্রিস্টপূর্ব ১১৯৪ সালে ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস ও বড় ভাই হেক্টর ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত চুক্তি করার জন্য স্পার্টায় আসেন।


প্রাচীন গ্রিস ও ট্রয় বর্তমান তুরস্ক ছিল পাশাপাশি দুই রাষ্ট্র। তবে এর মাঝে ছিল বিখ্যাত এজিয়ান সাগর। স্পার্টার রাজা মেনিলাস দুই রাজপুত্রকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে বরণ করে নেন। তাদের আগমনে রাজ্যকে বর্ণিল সাজে সাজানো হয়। যুবরাজদের সম্মানে নৈশভোজেরও আয়োজন করা হয়। আর এই নৈশভোজের সময়ই যুবরাজ প্যারিসের সঙ্গে পরিচয় ঘটে অনিন্দ্যসুন্দরী হেলেনের। মেনিলাস নিজেই স্ত্রী হেলেনকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। 


কিন্তু কে জানত এই পরিচয়ই জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলে পরিণত হবে মেনিলাসের। ব্যবসায়িক আলোচনার জন্য স্পার্টায় প্রায় ২০ দিন অবস্থান করেন প্যারিস ও হেক্টর। বড় ভাই হওয়ার ফলে বাণিজ্যসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হেক্টরের ঘাড়েই ন্যস্ত থাকত। রাজা মেনিলাস আর হেক্টরের বানিজ্য-সংক্রান্ত ব্যস্ত সময় কাটাতেন আর প্যারিস গোপনে দেখা করতেন হেলেনের সঙ্গে। 


প্রথম দেখাতেই হেলেনের রূপ বিমোহিত করেছিল প্যারিসকে। হেলেনের প্রেমে পাগল ট্রয় রাজপুত্র প্যারিসও ছিলেন সুপুরুষ। প্যারিসের চেহারা, শরীরী গঠন সবকিছুই আকর্ষণ করতে শুরু করে হেলেনকে। অল্প সময়ের মধ্যেই হেলেনও প্যারিসের প্রতি প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়েন। এদিকে হেক্টরও বানিজ্য-সংক্রান্ত কাজ প্রায় শেষ করে এনেছেন। এবার বিদায়ের পালা। ভোর হলেই তারা রওনা দেবেন ট্রয়ের উদ্দেশ্যে। রাজা মেনিলাসের আপ্যায়নেরও কোনো কমতি ছিল না। 


রাজকীয় খাবার-পানীয় আয়োজনের পাশাপাশি ছিল সুন্দরী রমণীদের আতিথেয়তা। নর-নারী, প্রহরী-রাজা, হেক্টর ও ট্রয়ের অতিথিরা যখন আমোদ-প্রমোদ আর নাচ-গানে বুঁদ, প্যারিস তখন চুপিসারে চলে গেলেন হেলেনের ঘরে। হেলেনও যেন প্যারিসের অপেক্ষায়ই প্রহর গুনছিলেন। প্রিয় মানুষকে কাছে পেয়ে দুজনেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। ঘনিষ্ঠ সময় কাটানোর পর হেলেনকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলেন প্যারিস। ভয়াবহ বিপদের আশঙ্কা থাকলেও প্রেমের টানে হেলেনও রাজি হলেন যেতে। হেক্টর এসবের কিছুই জানতেন না।


যথারীতি অতিথিদের বিদায় জানাল স্পার্টাবাসী। তখনো কেউ জানত না তাদের প্রিয় রানীকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন ট্রয়ের রাজকুমার প্যারিস। এজিয়ান সাগরের মাঝপথে এসে প্যারিস হেক্টরকে বলেন, হেলেন তাদের সঙ্গে এসেছেন। প্যারিসের কথা শুনে হতবাক হেক্টর! রাগে, ক্ষোভে জাহাজ স্পার্টার দিকে ঘোরানোর নির্দেশ দিলেন নাবিকদের।কিন্তু প্যারিসের অনুরোধ আর কান্নায় হেক্টর নিজের মত পরিবর্তনে বাধ্য হন। এদিকে স্পার্টায় ছড়িয়ে পড়ে প্যারিস হেলেনকে অপহরণ করে নিয়ে গেছেন ট্রয়ে।


রাজা মেনিলাস হেলেনকে হারিয়ে ক্রুদ্ধ ও পাগলপ্রায়। রাজ্যের সম্মান ফিরিয়ে আনতে মাইসেনিয়ার রাজা,ভাই আগামেননের সাহায্য প্রার্থনা করেন তিনি। সে বছরই খ্রিষ্টপূর্ব ১১৯৪ সালে এক হাজারেরও বেশি জাহাজে করে বিশাল সৈন্য বাহিনী যাত্রা করে ট্রয়ের উদ্দেশ্যে। সেনাপতির দায়িত্ব নিজ হাতেই রাখেন আগামেনন। পাশাপাশি যুদ্ধে যুক্ত করা হয় গ্রিসের বীরযোদ্ধা একিলিসকেও। 


আগামেননের কাছে ভাইয়ের স্ত্রী হেলেন কে উদ্ধার করা যতটা না গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল ট্রয়ের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন। একারনেই একিলিস আগামেননের সাথে দ্বিমত পোষণ করতেন। তাঁকে রাজা বলে স্বীকার করতেও অস্বীকৃতি জানান। হঠাৎই রাজ্যের বিপদ টের পেয়ে বাজানো হয় রাজ ঘন্টা। প্রজারা ছোটাছুটি করতে থাকে দিগ্বিদিক। 


প্রাসাদ থেকে হেক্টর ও পিতা প্রিয়াম দেখতে পান শত শত জাহাজ ধেয়ে আসছে ট্রয়ের দিকে। মুহূর্তের মধ্যেই কালো মেঘে ছেয়ে যায় গোটা সাম্রাজ্য।এদিকে গোপনে গভীর রাতে ট্রয় থেকে পালিয়ে যেতে চান হেলেন। কিন্তু ধরা পড়েন হেক্টরের হাতে। হেক্টর তাকে সাহস দেন আর বিজয় ট্রয়েরই হবে বলে আশ্বস্ত করেন। ফলে ট্রয়েই থেকে যান হেলেন। জাহাজ থেকে নেমেই যুদ্ধ শুরু করেন একিলিস ও তার সঙ্গীরা।


প্রথম যুদ্ধেই ট্রয় নগরীর বন্দর দখল করেন নেয় গ্রিকরা। এভাবে টানা ১০ বছর বন্দর ও রাজ্য অবরোধ করে রাখে গ্রিকরা। বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধে নিহত হয় একিলিসের ভাই উইরোরাস, প্যারিসের বড় ভাই ট্রয় বীর হেক্টর ও নাম না জানা উভয় পক্ষের হাজারো যোদ্ধা। যুদ্ধে সহজে জয়লাভ না করতে পেরে শেষপর্যন্ত প্রতারণার আশ্রয় নেয় স্পার্টানরা । 


তৈরি করে বিশালাকৃতির অদ্ভুত এক ঘোড়া। যা ইতিহাসে জঘন্যতম প্রতারনার প্রতীক ‘ট্রোজান হর্স’ নামেই খ্যাত। আর এই ঘোড়াতেই লুকিয়ে ছিল ট্রয়ের পরাজয়। যেখান থেকেই এই ‘ট্রোজান ওয়ার’ বা ‘ট্রোজান যুদ্ধ’। যার স্থায়িত্বকাল ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ১১৯৪ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ১১৮৪ সাল পর্যন্ত। দীর্ঘ ১০ বছর। এপিয়াস নামে মুষ্টিযোদ্ধা ও দক্ষ ছুঁতার সুবিশাল এই ঘোড়াটি তৈরি করেন। পলায়নের ভান করে স্পার্টান সৈন্যরা জাহাজে করে নিকটবর্তী টেনিডোস দ্বীপে চলে যায়। যাবার সময় তারা সাইননকে রেখে যায় সেখানে। সাইনন ট্রয়বাসীকে বোঝাল যে, ঘোড়াটি অপরাজেয়ের প্রতীক হিসেবে ট্রয়কে উপহার দেওয়া হয়েছে।


রাজা প্রিয়াম শুরুতে এই উপহার নিতে অস্বীকৃতি জানালেও রাজ জ্যোতিষীর পরামর্শে উপহার গ্রহন না করা অমঙ্গল বয়ে আনবে ট্রয়ের মত পাল্টাতে বাধ্য হন। ট্রয়বাসী আনন্দ-উল্লাস করতে করতে ঘোড়াটিকে নগর-দেয়ালের ভেতরে নিয়ে আসে। আর ভেতরে আত্মগোপন করে থাকা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গ্রিক যোদ্ধা অপেক্ষা করতে থাকে সন্ধ্যা নামার। 


এ কূটচালের কিছুই তখনো আঁচ করতে পারেনি ট্রয়বাসী। মূলত তাদের এই অদূরদর্শিতাই ধ্বংস ডেকে এনেছিলো ট্রয় নগরীর। রাতের গভীরে ঘোড়া থেকে বের হয়ে ট্রয়বাসীর ওপর অতর্কিতে হামলা চালায় স্পার্টানরা। খুলে দেয় নগরতোরণ। হাজারো গ্রিক সৈন্য রাজ্যে আগুন ধরিয়ে দেয় গোটা সাম্রাজ্যে। মুহূর্তেই ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় একসময়কার সমৃদ্ধ,সাজানো ও সুন্দর ট্রয়। আগুনে পুড়ে ছাঁই হয় হাজারো সৈন্য আর নিরীহ অধিবাসী।


এভাবেই ট্রয় রাজ্যের পরাজয় এবং ধ্বংস ডেকে নিয়ে আসে। এখন ট্রয় নগরী শুধু ইতিহাসের পাতার একটি অংশ। 



প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক যুগে আসা যাক।


অস্ট্রিয়ার রাজপরিবারের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ প্রেম করে সোফিকে বিয়ে করেন। 


১৯১৪ সালের ২৮ জুন দিনটি ফার্দিনান্দ ও সোফির জন্য ছিল বিশেষ তাৎপর্যময়। কারণ, এই রাজদম্পতির ৪০তম বিবাহবার্ষিকীও ছিল সেদিন। ১৯১৪ সালের জুনে অস্ট্রিয়ার রাজপরিবারের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ তাঁর স্ত্রী সোফিকে নিয়ে বসনিয়া সফরে যান। বসনিয়া ছিল তখন অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের দখলে।


এই দম্পতি ২৮ জুন বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভোতে অবস্থানরত অনুগত সেনাদের সঙ্গে দেখা করতে যান। এদিন ছিল তাঁদের বসনিয়া সফরের শেষ দিন এবং দিনটি ছিল রোববার।


প্রেম করে নিচু স্তরের কাউকে বিয়ে করার কারণে ফার্দিনান্দ ও সোফি কখনো অস্ট্রিয়ায় স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে পারেননি রাজপরিবারের কড়া নিয়মকানুনের কারণে। রাজত্ব থেকে অনেক দূরে বসনিয়ায় সেই নিয়ম বলবৎ ছিল না বলে সোফি সেদিন ছিলেন অনেকটাই খুশি এবং তিনি তাঁর স্বামীর সঙ্গে বেশ কিছু ছবি তুলেছিলেন। এই সফরে সোফি দারুণ খুশি থাকলেও বসনিয়ার অনেক মানুষ তখন তাঁদের আগমনে ক্ষুব্ধ ছিল। গন্তব্যস্থলে যাওয়ার সময় পথেই সার্বিয়ান সন্ত্রাসীদের ছোড়া হাতবোমা থেকে তাঁরা অল্পের জন্য বেঁচে যান।


এই যাত্রায় বেঁচে গেলেও দিনের আরও পরের দিকে আরেকটি হামলায় ভাগ্য তাঁদের সহায় হয়নি। সার্বিয়ার উগ্র জাতীয়তাবাদী গাভরিলো প্রিন্সিপের ছোড়া বুলেটে মারা যান ফার্দিনান্দ ও সোফি। প্রিন্সিপের বয়স তখন মাত্র ১৯ এবং তিনি ছিলেন এক দরিদ্র কৃষকের সন্তান। ইউরোপে তখন আততায়ীদের হাতে এমন প্রাণনাশের ঘটনা বিরল না হলেও অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য এ খুনের ঘটনায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয় এবং জার্মানির সহায়তায় এক মাসের মাথায় ২৮ জুলাই তারা সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।


আর্চডিউক ফার্দিনান্দও উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থানের কারণেই খুন হয়েছিলেন। তাঁকে গুলি করেছেন যে প্রিন্সিপ, তিনি ছিলেন সার্বিয়ান জাতীয়তাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্য, যারা বসনিয়ার ওপর অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের শাসন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিল না। বসনিয়ার কৃষকেরা তখন নিদারুণ বঞ্চনার শিকার হচ্ছিলেন, দিনের পর দিন শোষণের ভারে তাঁরা ছিলেন একেবারে পর্যুদস্ত। এসব ভয়ংকর দিন পরিবর্তনের জন্য কেউ যখন কিছু করছিল না, তখন দেশটির একদল তরুণ নিজেরাই কিছু একটা করতে উদ্যোগী হন। প্রিন্সিপ ছিলেন এই ‘বিপ্লবী’ দলের একজন।


মোট কথা, অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পর সে বছরের আগস্ট মাসে ফ্রান্স ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে জার্মানি। দ্রুততম সময়ে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় গ্রেট ব্রিটেনও জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে সে সময়ের সব কটি প্রভাবশালী দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে যায়। অক্টোবর মাসে যখন প্রিন্সিপের বিচার শুরু হলো, ততক্ষণে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে।


তার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জার্মানি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, দখল করে নেয় বেলজিয়াম ও ফ্রান্স। রাশিয়া তখন ছিল সার্বিয়ার বন্ধুরাষ্ট্র। এসব ঘটনা ব্রিটেনের মোটেও পছন্দ হয়নি। তারা জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসে। এক দেশ অন্য দেশ দখল করার মতো ঘটনা ইউরোপে মোটেও নতুন কিছু ছিল না। এসব ঘটনা ছিল তারই প্রতিফলন।


প্রথম বিশ্বযুদ্ধে একপক্ষে ছিল উসমানীয় সাম্রাজ্য, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, জার্মানি ও বুলগেরিয়া। যাদের বলা হতো কেন্দ্রীয় শক্তি। আর অপরপক্ষে ছিল সার্বিয়া, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জাপান, ইতালি, রুমানিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যাদের বলা হতো মিত্রশক্তি।


দ্য গ্রেট ওয়ার বা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ট্যাংক এবং রাসায়নিক অস্ত্রের মতো প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। সে যুদ্ধে প্রাণ যায় প্রায় ৯০ লাখ মানুষের! এবং জার্মানীর পরাজয় ঘটে।


প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের প্রেক্ষাপট দেশটির ইতিহাসের এক করুণ অধ্যায়। যুদ্ধের বিজয়ী পক্ষের চাপিয়ে দেয়া‌ অন্যায় ও অন্যায্য চুক্তিসমূহ দেশটির অর্থনীতির মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে। ভার্সাই চুক্তির ফলে আবির্ভূত হওয়া ভাইমার প্রজাতন্ত্রের কার্যকারিতা পরীক্ষার মুখে পড়ে। পুরো জার্মান সমাজ এক অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্যে পতিত হয়। 


রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সংকট, খাদ্য ঘাটতি, বেকার সমস্যা, বাণিজ্য মন্দা, জনসংখ্যা সমস্যা, দ্রব্য সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধিসহ নানান সমস্যা জার্মান জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। জনগণের মনে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশার কালো মেঘ ঘনীভূত হতে থাকে যা তাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রতিশোধের আগুনকে জাগিয়ে তোলে। ফলশ্রুতিতে ইতালির ফ্যাসিস্টদের আদলে জার্মানিতে নাৎসি নামে এক উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটে।


জার্মানির জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল যা পৃথিবীব্যাপী নাৎসিবাদী বা নাৎসি পার্টি নামে সমধিক পরিচিত। এটি একটি উগ্ৰ ডানপন্থী জার্মান জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী রাজনৈতিক মতাদর্শ যা ইতালির ফ্যাসিবাদের সমপর্যায়ের রাজনৈতিক দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। নাৎসিবাদের মধ্যে রয়েছে বৈজ্ঞানিক কৌলিবাদ, ইহুদি বিদ্বেষী মনোভাব ও সাম্যবাদ বিরোধী অগণতান্ত্রিক চেতনা। আনুষ্ঠানিকভাবে বলতে গেলে নাৎসিবাদ হলো জার্মান চ্যান্সেলর এডলফ হিটলারের রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনা ও আদর্শের সাথে সম্পর্কিত বিষয়াদি যার মূলমন্ত্র জার্মানির জাতীয় সমাজতান্ত্রিক পার্টির প্রতিষ্ঠার সাথে নিহিত রয়েছে।


বিসমার্কের শাসনামলে জার্মানি পুরো পৃথিবী জুড়ে যে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার পরিসমাপ্তি ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। জার্মান রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করে যে ভাইমার প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা অচিরেই প্রশ্নবিদ্ধ হয় পর্যাপ্ত রাজনৈতিক সমর্থনের অভাবে। প্রজাতন্ত্রের দুর্বলতার সুযোগে জার্মানিতে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে শুরু করে, প্রজাতন্ত্র বিরোধীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর আঁতাত পাকাপোক্ত হতে থাকে, অর্থনৈতিক মন্দাসহ অন্যান্য কারণে তৎকালীন ভাইমার প্রজাতন্ত্রের নেতা ফ্রেডরিক এর্বাটের প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়ে, সরকারের পক্ষে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা অসম্ভব হয়ে পড়ে। 


পক্ষান্তরে বিদ্যমান সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, জনগণের অনুভূতিকে কাজে লাগাতে এডলফ হিটলার তৎপর হয়ে ওঠেন। তিনি জার্মানিকে তার হারিয়ে যাওয়া গৌরব পুনরুদ্ধার করে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও শ্রেষ্ঠতম জাতি হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেন যা তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তিনি খুবই অল্প সময়ের ব্যবধানে জার্মানির সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা ও জাতীর স্বপ্নদ্রষ্টার আসনে অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম হন। হিটলার ও নাৎসি দল একে অপরের পরিপূরক হিসেবে জার্মানির সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।


হিটলারের নেতৃত্বে সুপ্রতিষ্ঠিত নাৎসি পার্টি সেসকল নীতিমালার অনুসরণ করত তা কিন্তু নব উদ্ভাবিত কোন মতবাদ ছিল না। উদারতাবাদ, যুক্তিবাদ এবং মার্ক্সবাদ বিরোধী মতাদর্শের বিপরীতে জার্মান আর্য রক্ত, জার্মান ভাষা ও সকল ধর্মীয় বিশ্বাসমুক্ত উগ্ৰ জাতীয়তাবাদী চেতনাই ছিল নাৎসি পার্টির ভৌতভিত্তি। নাৎসি পার্টির মূল প্রতিপাদ্য ছিল আর্য রক্তের ধারক জার্মানরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি এবং পৃথিবীর নেতৃত্ব লাভের অধিকার একমাত্র তাদেরই আছে।


১৯২০ সালে  এডলফ হিটলার নাৎসি পার্টির জন্য পঁচিশ দফা সম্বলিত এক ইশতেহার জারি করেন যা তৎকালীন জার্মানির জনমনে ব্যাপক আশার সঞ্চার করে। আশাহত জার্মান সমাজের কাছে হিটলার একমাত্র ত্রাতা হিসেবে অভিহিত হন। জার্মানির যুবসমাজ হিটলারের নাৎসি পার্টির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে এবং দিনে দিনে হিটলারের প্রভাব চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে। তিনি ১৯৩৩ সালে জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তার নাম পৃথিবীর ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে পরিনত হয়।


১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর জার্মান জাহাজ থেকে বোমা বর্ষণ করা হয় ডানজিগ বন্দরের অদূরে এক উপদ্বীপে পোলিশ অবস্থানের উপর৷ তার অল্প পরে প্রায় দেড় লক্ষ জার্মান সেনা সীমান্ত অতিক্রম করে ঢুকে পড়ে পোল্যান্ডে৷

শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ৷ পাল্টে যায় বিশ্ব, ইতিহাস মোড় নেয় নতুন দিকে৷


ভোর পৌনে পাঁচটার দিকে জার্মান যুদ্ধ জাহাজ বোমা বর্ষণ করে ডানজিগের কাছে পোল্যান্ডের অস্ত্রাগারের উপর৷ পোল্যান্ডের উপর আক্রমণ চলে পূর্ণ গতিতে৷ জার্মান একনায়ক হিটলার ঘোষণা করেন, পোল্যান্ড আজ রাতে প্রথম আমাদের সীমান্ত অতিক্রম করেছে, আমাদের সেনাদের ওপর গুলি চালিয়েছে৷ ভোর পৌনে ছ'টা থেকে পাল্টা গোলাগুলি শুরু হয়েছে৷ এবং এখন থেকে বোমার জবাব দেবে পাল্টা বোমা৷


হিটলারের ঐ নির্জলা মিথ্যে দিয়েই যুদ্ধের শুরু৷ কারণ সেসব সেনা ছিল হিটলারের বিশেষ এসএস বাহিনীর সদস্য৷ তাদের পরণে নিয়েছিল পোলিশ সেনাদের পোশাক৷


প্রায় দেড় লক্ষ সশস্ত্র জার্মান সশস্ত্র সেনা দ্রুত এগিয়ে যায় পোল্যান্ডের সীমান্তে৷ হিটলারের মিথ্যাচারের মূল্য পোলিশদের দিতে হয় জীবন দিয়ে৷


পোল্যান্ড আক্রমণের এক সপ্তাহ আগে হিটলার এবং স্ট্যালিনের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়৷ এই চুক্তির ফলেই পোল্যান্ড আক্রমণ করা জার্মানির জন্য অনেক সহজ হয়ে যায়৷ চু্ক্তিতে উল্লেখ ছিল পোল্যান্ডকে ভেঙে ফেলা হবে৷ পোল্যান্ডকে ভাগাভাগি করে নেবে জার্মানি এবং তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন৷


দ্রুত স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ভূখন্ড দখলই শুধু নয়, পোলিশ জাতিকে ধ্বংস করাও লক্ষ্য৷ এরপরই শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ৷ পোল্যান্ডের শিক্ষিত এবং সুশীল সমাজকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্যোগ৷ অধ্যাপক, চিকিৎসক, আইনবিদ, লেখক, রাজনীতিকদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়৷ চালানো হয় নির্বিচার ইহুদী নিধন৷


৩৬ দিন পর পোল্যান্ড হার মানতে বাধ্য হয়৷ উল্লাসে ফেটে পড়ে স্ট্যালিন এবং হিটলার৷ পোল্যান্ডকে ভাগ করে নেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং জার্মানি৷ ফ্রান্স আর গ্রেট ব্রিটেন যুদ্ধ ঘোষণা করে পোল্যান্ডের উপর জার্মান আক্রমণের দুদিন পর৷


পাঁচ বছর ধরে পোল্যান্ড গণহত্যার শিকার হয়৷ প্রাণ হারায় প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ৷ এর মধ্যে ছিল তিন লক্ষ পোলিশ ইহুদী৷ পোল্যান্ড আক্রমণ হিটলারের জন্য ছিল আরো বড় এক যুদ্ধেরই মহড়া৷ বিশ্বযুদ্ধ আদতে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল এরপরই৷


এরপর বিশ্ব দুভাগে বিভক্ত হয়ে অক্ষশক্তি ও মিত্রশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্র শক্তি বলতে সেসব দেশকে নির্দেশ করা হয়, যারা অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫) সময় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। মিত্রশক্তির দেশগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল প্রত্যক্ষভাবে অক্ষশক্তির আগ্রাসনের কারণে অথবা অক্ষশক্তি কর্তৃক আক্রান্ত হতে পারে এমন ভয়ের কারণে।


১৯৪১ সালের পরে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন এই তিন রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দ, যারা একত্রে 'বৃহৎ তিন' নামে পরিচিত ছিল এবং চীন মিত্র শক্তি গঠন করে। পরবর্তীতে বৃহৎ রাষ্ট্র ফ্রান্সও মিত্রশক্তিতে যোগ দেয়। এছাড়া আরও যে সব রাষ্ট্র মিত্র শক্তিতে যোগ দেয় তারা হল অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, কানাডা, চেকোস্লাভিয়া, ইথিওপিয়া, গ্রীস, ভারত, মেক্সিকো, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, ফিলিপাইন কমনওয়েলথ, পোল্যান্ড এবং যুগোস্লাভিয়া।


১৯৪১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন ডিলানো রুজভেল্ট মিত্রশক্তিকে জাতিসংঘ নামে প্রচার করেন। তিনি বৃহৎ তিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনকে একসাথে ট্রাস্টিশিপ অব পাওয়ারফুল নামে অভিহিত করেন, পরে যা ফোর পুলিশম্যান নামে পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে ১৯৪২ সালে একটি ঘোষণার মাধমে বর্তমান জাতিসংঘের গোড়াপত্তন হয়।


১৯৪৫ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে পটসডাম সন্মেলনে রুজভেল্ট প্রস্তাব করেন চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহে শান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার রূপরেখা প্রণয়ন করবে। যার মাধ্যমে পরবর্তীতে পররাষ্ট্র মন্ত্রী পরিষদ গঠিত হয়।



দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তি বলতে সেসব দেশকে নির্দেশ করা হয় , যারা মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫) সময় যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। অক্ষশক্তির প্রধান তিনটি রাষ্ট্র হল জার্মানি, ইটালী এবং জাপান। এই তিনটি রাষ্ট্র ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে একটি সামরিক জোট গড়ে তোলে। এর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভাবে অক্ষশক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর সাথে সাথে তাদের ইউরোপ, আফ্রিকা, পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থিত কলোনিগুলোও অক্ষশক্তির অংশ হয়ে যায়। মিত্রশক্তির মতই অক্ষশক্তিতেও বেশ কিছু দেশ নাম লিখিয়ে যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই তা প্রত্যাহার করে নেয়।


অক্ষ কথাটি সর্বপ্রথম আলোচনায় আনেন হাঙ্গেরীর ফ্যাসিবাদী প্রধানমন্ত্রী গাইওলা গমবোস। তিনি জার্মানি, হাঙ্গেরী, এবং ইতালী এই তিনটি রাষ্ট্র নিয়ে একটি জোট গঠনের জন্য কাজ করছিলেন। এছাড়া তিনি জার্মানি এবং ইতালীর মাঝে মতভিন্নতা দূর করার কাজে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করছিলেন। কিন্তু ১৯৩৬ সালে মিউনিখে জার্মানির সাথে আলোচনায় গিয়ে তার হঠাৎ মৃত্যু হয়। পরবর্তিতে হাঙ্গেরীর ক্ষমতায় আসে ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তি। এর মাধ্যমে হাঙ্গেরী অক্ষশক্তির সাথে প্রাথমিক সংশ্লিষ্টতা থেকে সরে আসে। তারপরেও জার্মানি এবং ইতালীর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক অক্ষশক্তি গঠিত হয়।


১৯৩৬ সালের নভেম্বরে ইতালীর একনায়ক বেনিতো মুসোলিনি আবার অক্ষ শব্দটি আলোচনায় আনেন। তিনি রোম-বার্লিন অক্ষের উত্থানের সময় এই অক্ষের কথা বলেন। পরবর্তিতে রাষ্ট্র দুটি জোট গঠন করে। মুসোলিনি এই জোটকে প্যাক্ট অব স্টীল বলে অভিহিত করেন।


আনুষ্ঠানিক ভাবে অক্ষ শক্তি নামকরণ করা হয় ১৯৪০ সালে জার্মানি, ইতালী এবং জাপান ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরের পর। পরবর্তিতে হাঙ্গেরী (২০শে নভেম্বর, ১৯৪০), রোমানিয়া (২৩শে নভেম্বর, ১৯৪০), স্লোভাকিয়া (২৪শে নভেম্বর, ১৯৪০) এবং বুলগেরিয়া (১লা মার্চ, ১৯৪০) ঐ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।



পার্ল হারবারের আক্রমণের মধ্যে দিয়ে আমেরিকা পূর্ণভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে যায় চুরান্তভাবে।


পার্ল হারবার যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই অঙ্গরাজ্যের রাজধানী হনলুলু এর কাছে অবস্থিত একটি নৌঘাঁটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪১ সালের ৭ই ডিসেম্বর জাপানি বাহিনী পার্ল হারবারে আকস্মিকভাবে বিধ্বংসী এক আক্রমণ পরিচালনা করে। দিনটি ছিলো রবিবার। সকাল আটটার ঠিক আগে প্রায় শ`খানেক জাপানি যুদ্ধবিমান নৌঘাঁটিটির উপর হামলে পড়ে।

ধ্বংস করে দেয় ২০টি আমেরিকান নৌ জাহাজ, আটটি রণতরী এবং তিন শতাধিক উড়োজাহাজ। সেই আক্রমণে প্রায় আড়াই হাজার আমেরিকান মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তাদের অনেকেই ছিলেন নিরীহ বেসামরিক মানুষ। হাজার খানেক লোক মারত্মক আহত হন। এমন নৃশংসতার ঠিক পরের দিনই যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণায় কংগ্রেসকে আহ্বান জানান।



 

পার্ল হারবার যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই অঙ্গরাজ্যের রাজধানী হনলুলু এর কাছে অবস্থিত একটি নৌঘাঁটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪১ সালের ৭ই ডিসেম্বর জাপানি বাহিনী পার্ল হারবারে আকস্মিকভাবে বিধ্বংসী এক আক্রমণ পরিচালনা করে। দিনটি ছিলো রবিবার। সকাল আটটার ঠিক আগে প্রায় শ`খানেক জাপানি যুদ্ধবিমান নৌঘাঁটিটির উপর হামলে পড়ে।

ধ্বংস করে দেয় ২০টি আমেরিকান নৌ জাহাজ, আটটি রণতরী এবং তিন শতাধিক উড়োজাহাজ। সেই আক্রমণে প্রায় আড়াই হাজার আমেরিকান মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তাদের অনেকেই ছিলেন নিরীহ বেসামরিক মানুষ। হাজার খানেক লোক মারত্মক আহত হন। এমন নৃশংসতার ঠিক পরের দিনই যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণায় কংগ্রেসকে আহ্বান জানান।





জাপান-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্বের ইতিহাস

পার্ল হারবার আক্রমণ অতর্কিত হলেও জাপান আর যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু বহু আগে থেকেই একে অপরের উপর যুদ্ধাংদেহী মনোভাবী ছিলো। তখন জাপানি সরকার বিশ্বাস করত, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের একমাত্র পন্থা হচ্ছে চীনের বিভিন্ন অঞ্চল দখলে নিয়ে বাণিজ্য ঘাটিতে পরিণত করা। এর ফলসবরূপ ১৯৩৭ সালে জাপান সরকার চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। চীনের নানকিং শহরে গণহত্যা চালিয়ে তারা লাখখানেক নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।  চীনের প্রতি জাপানের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী মনোভাবকে যুক্তরাষ্ট্র কিছুতেই ভালোভাবে নেয়নি।


আমেরিকান কর্মকর্তারা চীনের উপর জাপানের এই অন্যায় আক্রমণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে জাপানের উপর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তারা ভেবেছিলো তেল এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ বন্ধ করে দিলে জাপানিরা তাদের সম্প্রসারণ নীতি স্থগিত করতে পারে। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা জাপানিদেরকে আরো তৎপর করে তুলল। টোকিও এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনা ব্যর্থ হলো। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ তখন প্রায় অবশ্যম্ভাবী।


জাপানিদের অতর্কিত আক্রমণে ধ্বংস হয় পার্ল হারবার। কেন জাপানিরা পার্ল হারবারকে আক্রমণের জন্য বেছে নিলো?  


পার্ল হারবার ছিলো আমেরিকার মূল ভূখণ্ড থেকে দুই হাজার ও জাপান থেকে চার হাজার কিলোমিটার দূরে। প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে ছিলো নৌঘাঁটিটির অবস্থান। আমেরিকান সরকার ভাবতেও পারেনি এত দূরে এসে জাপানিরা আক্রমণ করতে পারে। তাই পার্ল হারবার ছিলো অনেকটাই অরক্ষিত। জাপানিদের জন্যও ছিলো সহজ টার্গেট। তাই প্রশান্ত মহাসাগরে নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে জাপান পার্ল হারবারকেই বেছে নিলো।


কি ছিলো পার্ল হারবার আক্রমণের উদ্দেশ্য?

জাপানিদের লক্ষ্য ছিলো দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। পার্ল হারবারে আক্রমণ করে ইউএস নেভীর প্রশান্ত নৌবহর পুরোপুরি ধ্বংস করাই ছিলো তাদের উদ্দেশ্য। প্রশান্ত নৌবহর বা প্যাসিফিক ফ্লিট ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৃহৎ বহর যা প্রশান্ত মহাসাগর জুড়ে আমেরিকানদের কর্তৃত্ব বহাল রাখছিলো। যাই হোক, অ্যাডমিরাল ইয়ামামোতো ইসোরোকুর নেতৃত্বে জাপানি বিমান বাহিনী কয়েক মাস ধরে প্যাসিফিক ফ্লিট ধ্বংসের পরিকল্পনা করে আসছিলো। সে কারণেই পার্ল হারবার আক্রমণ করে তারা।


জাপানিরা পার্ল হারবার আক্রমণ করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় এবং অনেক ক্ষতি সাধন করতে সমর্থ হয়। তাই প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে এ আক্রমণে জাপানিরাই সফলকাম হয়। কিন্তু প্যাসিফিক ফ্লিট পুরোপুরি ধ্বংসে ব্যর্থ হয় জাপান। আমেরিকান যুদ্ধবিমান বহনকারী একটি জাহাজও তখন পার্ল হারবারে উপস্থিত ছিলো না। এদিকে জাপানি বাহিনীর তেলের মজুদ ও গোলাবারুদ শেষ হয়ে যায়। তাই এ আক্রমণ তার মূল উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয়।


উলটো জাপানিদের এ জন্য ভয়ানক পরিণতি হয়। পার্ল হারবার আক্রমণের পর যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পারমাণবিক বোমা মেরে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি- বড় দুইটি শহর উড়িয়ে দেয়। অসহায় আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় জাপান। তাদের পার্ল হারবার আক্রমণের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের ফলে পরবর্তীতে লাখ লাখ নিরীহ মানুষ নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করে, ইতি ঘটে অজস্র জীবন ও স্বপ্নের।



১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর জাপান সাম্রাজ্যের সশস্ত্র বাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে এশিয়াতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। আত্মসমর্পণের ঘটনাটি ইউরোপে অক্ষ বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রায় চার মাস পরে ঘটে এবং এর মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।



১৯৪৫ সালের এপ্রিল মাসে মিত্রবাহিনী উত্তর ইতালির সর্বশেষ জার্মান প্রতিরক্ষা ভেঙে ফেলে এবং তখন এখানকার শহরগুলিতে তার নিজের পার্টির সদস্যদের দ্বারা সাধারণ অভ্যুত্থানের ফলে মুসোলিনির পরিস্থিতি কার্যত অচল হয়ে পড়ে। 


২৫ এপ্রিল তিনি মিলান থেকে পালিয়ে যান, এবং সুইস সীমান্ত দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। ১৯৪৫ সালের ২৭ এপ্রিল মুসোলিনি তাঁর উপপত্নী ক্লেরেট্টা পেটাকি এবং অন্যান্য ফ্যাসিবাদী নেতাদের সাথে লেক কোমোর উত্তর পশ্চিম তীরে দোঙ্গো গ্রামের কাছে একটি জার্মান কনভয়ে ভ্রমণ করছিলেন।


সে সময় পিয়র লুইজি বেলিনি ডেলি স্টেল এবং আরবানো লাজারোর নেতৃত্বে একদল স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টির লোকেরা এই কনভয়ে আক্রমণ করে এবং এটি থামাতে বাধ্য করে। সুরক্ষার দায়িত্তে থাকা জার্মানরা কনভয়ের সকলকে ইতালিয়দের হাতে তুলে দেয়ার বিনিময়ে তাদের মুক্ত করে নেয়।


পারটিশান্সরা কনভয়ে মুসলিনিকে খুঁজে পায় এবং গ্রেপ্তার করে তাকে ডঙ্গোতে নিয়ে যায়, যেখানে তিনি স্থানীয় ব্যারাকে রাতের কিছুটা সময় কাটিয়েছিলেন।


কমিউনিস্টরা মুসোলিনি এবং পেটাকিকে বাদ দিয়ে, তাদের মধ্যে সর্বাধিক ষোলজনকে পরের দিন ডঙ্গোতে গুলি করা হয় এবং এরপর আরও দশজনকে পরপর হত্যা করা হয়। সব শেষে মুসোলিনি এবং তার উপপত্নী ক্লেরেট্টা পেটাকির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ধারণা করা হয়, অ্যাডলফ হিটলারের আত্মহত্যার দু’দিন আগের বিকেলে মুসোলিনি এবং পেটাকিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।


মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরে মুসোলিনি এবং পেটাকির মৃতদেহ মিলানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং একটি বৃহত বিক্ষুব্ধ জনতার কাছে লাঞ্ছিত ও শারীরিক নির্যাতনের স্বীকার হওয়ার জন্য পিয়াসালে লরেটো শহরতলির একটি চত্বরে রেখে দেয়া হয়। এরপরে সেখানেই তাদের একটি জ্বালানী সরবরাহকারী স্টেশনের উপরে ধাতব গার্ডার থেকে উল্টে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল। স্থানীয় জনতা লাশগুলিকে মারধর করা করে, হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে, এমনকি মৃত দেহে গুলিও করা হয়েছিল। 


প্রথমদিকে মুসোলিনীকে একটি চিহ্ন বিহীন সমাধিতে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। কিন্তু মুসলিনি মনেহয় মৃত্যুর সাথে সাথে অশান্তি কে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন, আর সে কারনেই ১৯৪৬ সালে সমাধি থেকে তাঁর দেহটি ফ্যাসিবাদী সমর্থকরা চুরি করে নিয়ে যায়। এর চার মাস পরে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক দেহাবশেষটি পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল এবং পরবর্তী এগারো বছর এটি লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো।


অবশেষে, ১৯৫৭ সালে, তাকে তাঁর নিজের শহর প্রেদাপিওতে সমাধিস্থ করা হয়। বর্তমানে তাঁর সমাধিটি নব্য-ফ্যাসিস্টদের তীর্থস্থান হয়ে উঠেছে এবং তাঁর মৃত্যু বার্ষিকীতে নব্য-ফ্যাসিবাদীরা নিয়মিত বিভিন্ন সমাবেশ এর মাধ্যমে তাকে স্মরণ করে থাকে।


১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল বেলা তিনটের অল্প পূর্বে হিটলার মাটির পঞ্চাশ ফুট নিচে তার বাঙ্কারের করিডোরে বের হয়ে এলেন। সঙ্গে তার নব-পরিণীতা বধূ ইভা, প্রায় পনের বছরের পরিচয়ের পর তিনি প্রায় চল্লিশ ঘণ্টা আগে ইভাকে বিয়ে করেছেন। করিডোরে হিটলারের অতি বিশ্বস্ত কিছু মন্ত্রী, সেক্রেটারি, সেনাপতি, স্টেনো দাঁড়িয়েছিলেন। হিটলার ও ইভা নীরবে একে একে সকলের সঙ্গে করমর্দন করলেন। 


তারপর নিতান্ত যে কজনের প্রয়োজন তারা করিডোরে রইলেন, বাদ বাকিদের বিদায় দেয়া হলো। হিটলার ও ইভা খাস কামরায় ঢুকলেন।

অনুচরেরা বাইরে প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর একটিমাত্র পিস্তল ছোড়ার শব্দ শোনা গেল। অনুচররা আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন- তারা ভেবেছিলেন দুটো শব্দ হবে। সেটা যখন শোনা গেল না তখন তারা কামরার ভেতরে ঢুকলেন। সেখানে দেখতে পেলেন, তিনি সামনের দিকে ঝুঁকে বসে আছেন, কিংবা পড়ে আছেনও বলা যেতে পারে। তার খুলি, মুখ এবং যে সোফাটিতে তিনি বসেছিলেন সব রক্তাক্ত। 


কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। তার কাধে ইভার মাথা হেলে পড়েছে। ইভার কাছেও মাটিতে একটি ছোট পিস্তল। কিন্তু তিনি সেটা ব্যবহার করেননি। বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। অথচ কী প্রবল পরাক্রান্তই না ছিলেন তিনি কিছুদিন আগেও। যার প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষায় পৃথিবীজুড়ে প্রাণ দিয়েছে প্রায় ৫ কোটি মানুষ সেই মানুষটিরই এই করুণ মৃত্যু?


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তখন শেষদিক। জার্মান সেনারা অবিরাম মার খাচ্ছে। রাশিয়া, ফ্রান্স, পোলান্ড সব জায়গায় হেরে গিয়ে কোনোমতে জার্মানিকে টিকিয়ে রেখেছে। ১৯৪৫ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি বার্লিন শহরের পশ্চিমে অবস্থান নিল মার্কিন-ইংরেজ সৈন্য আর পূর্বদিকে রাশান সৈন্য। বার্লিন প্রায় অবরুদ্ধ। এই বার্লিন শহরেই হিটলারের বাঙ্কার তথা রাষ্ট্রপতি ভবন।


২০ এপ্রিল হিটলারের জন্মদিন। এ উপলক্ষে হিটলারের মন্ত্রী, সেনাপতি, সেক্রেটারি আর অন্তরঙ্গ কিছু মানুষ এসে উপস্থিত হয়েছেন বাঙ্কারে। এদের প্রায় সকলেই জানতেন হিটলারের সঙ্গে এই তাদের শেষ দেখা, কারণ রাশানরা বার্লিনের প্রায় চতুর্দিকে বৃত্তাকার ব্যূহ নির্মাণ করে ফেলেছে। কিন্তু হিটলার আশা হারাতে চাইলেন না। তিনি হুকুম দিলেন বার্লিনে ও বার্লিনের চতুর্দিকে যেসব সৈন্য রয়েছে তারা যেন সবাই একত্র হয়ে একজোটে সব ট্যাংক, সব জঙ্গিবিমান নিয়ে বার্লিনের দক্ষিণে রুশসৈন্যদের আক্রমণ করে। 


কিন্তু আফসোস হিটলার জানেন না জার্মান সেনাদের ব্যাটালিয়নের পর ব্যাটালিয়ান নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে,অস্ত্র নেই তাদের, বোমারু বিমান পেট্রলের অভাবে মাটিতেই শত্রুর বোমা দ্বারা বিনষ্ট হচ্ছে। যে হিটলার প্রায় পাঁচ কোটিরও বেশি নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুর পথ তৈরি করেছেন তিনি কেবল হুকুম দিয়েই খালাস। আর হুকুমও যে দিচ্ছেন সেটা সেই মাটির তলায় সুরক্ষিত বাঙ্কারে বসেই। এদিকে মার্কিন ইংরেজ বোমারু, জঙ্গিবিমান জার্মানির আকাশে একচ্ছত্রাধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং দিন নেই, রাত্রি নেই বেধড়ক বোমা ফেলে বার্লিন শহরটাকে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে হিটলার সে খবরও রাখেননা। ২১ এপ্রিল আক্রমণ করার যে হুকুম হিটলার দিয়েছিলেন সেটা ঘটেনি। একখানি বোমারু বা জঙ্গিবিমানও আকাশে ওঠেনি।



হিটলার এ সংবাদ পেয়ে রাগে, ক্ষোভে, চিৎকারে চিৎকারে গলা ফাটিয়ে হঠাৎ করেই শান্ত হয়ে বসে রইলেন। বুঝলেন যুদ্ধে পরাজিত হতে চলেছেন তিনি। কিন্তু হিটলারের মন্ত্রী, সেনাপতি সবাই তাকে বোঝাতে লাগলেন নিরাশ হবার মতো কিছু ঘটেনি। দক্ষিণ জার্মানি ও উত্তর ইতালিতে, বোহেমিয়া অঞ্চলে ও অন্যত্র এখনো অনেক অক্ষত সৈন্যবাহিনী আছে। হিটলার যদি জার্মানির গিরি উপত্যকায় তাদের জড়ো করেন তবে আরো অনেকদিন ধরে যুদ্ধ চালিয়ে ভাগ্য পরিবর্তন করা যাবে। কিন্তু হিটলার গোঁ ধরে বসে রইলেন যে বার্লিন ত্যাগ করবেন না।


২৫ তারিখে রুশসৈন্য সমস্ত বার্লিন চক্রব্যূহ ঘিরে ফেলল। এখন আর বার্লিন থেকে বেরুবার কোনো উপায় রইলো না হিটলারের। বাঙ্কারের ভেতর হিটলার পরামর্শ করেন তার অনুচরদের সাথে। কিন্তু কোনো সমাধান খুঁজে পান না। সেখানে শুধু ঐ খবরই পাওয়া যেত, রুশরা বার্লিনের কোন দিকে কতখানি ভিতরে ঢুকে পড়েছে। ইতোমধ্যে পূর্ব থেকে এসে রুশ সৈন্য ও পশ্চিম থেকে এসে মার্কিন সৈন্য মধ্য জার্মানিতে হাত মিলিয়েছে। জার্মানি এখন দুখণ্ডে বিভক্ত। বার্লিনের অবস্থা অবর্ণনীয়। অষ্টপ্রহর উপর থেকে বোমাবর্ষণ এবং তার সঙ্গে এসে জুটেছে শহরের উপকণ্ঠে বিরাট বিরাট কামান। বোমা ফেলছে বাঙ্কার এর উপর। 


হিটলার পশ্চিম রণাঙ্গনে খবর পাঠালেন জেনারেল ভেংক এর কাছে যাতে তিনি সৈন্যবাহিনী নিয়ে এসে বার্লিন শহর রক্ষা করেন। হিটলার তখনো আশা ছাড়েননি। কিন্তু জেনারেল ভেংক এর কোনো পাত্তাই নেই। বাঙ্কারে থাকতে থাকতে হিটলারের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়তে লাগলো। বয়সের চাইতেই বেশি বুড়োটে দেখাতে লাগলো। বাঙ্কারে সূর্যের আলো প্রবেশ করে না। দিনের পর দিন বিজলি বাতিতে কাজ করা লাগে পঞ্চাশ ফুট মাটির নিচে। সুর্যোদয়, সূর্যাস্ত কিছুই দেখা যায়না। বাইরের বিশুদ্ধ বাতাস যন্ত্রের সাহায্যে বাঙ্কারে ঠেলে দেয়া হয়। কিন্তু বোমাবর্ষণের ফলে বাইরের আকাশে মাঝে মাঝে এত ধুলোবালি জমে যেত যে বাতাসের সাথে সে ধুলোবালিও বাঙ্কারে প্রবেশ করতো। বাধ্য হয়ে কিছুক্ষণের জন্য বায়ুর যন্ত্র বন্ধ রাখতে হতো। ফলে অক্সিজেনের অভাবে সবাই নিরুদ্ধনিশ্বাস।


এদিকে রুশরা বার্লিন শহরের ভেতরে প্রবেশ করে গেছে। যে অল্পসংখ্যক জার্মান সৈন্য তখনো প্রতিরোদের চেষ্ঠা করছিল তাদের কচুকাটা করতে করতে এগিয়ে আসছে বাঙ্কারের দিকে। হিটলার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন যেহেতু সম্মুখযুদ্ধ করার মতো শারীরিক শক্তি তার আর নেই তাই রুশরা চলে এলে তিনি বার্লিনের রাস্তায় বীরের মতো যুদ্ধ করে প্রাণ দিতে পারবেন না। তিনি তখন আত্মহত্যা করবেন। একথা শোনে হিটলারের সব অনুচর তাকে বোঝাতে লাগলেন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার জন্য। কিন্তু তিনি অনড়। 


হিটলার এরপর দুটো উইল প্রস্তুত করলেন। প্রথম উইলখানা রাজনৈতিক, দ্বিতীয়খানা ব্যক্তিগত সম্পত্তির ভাগ- বাটোয়ারা নিয়ে। ৩০ এপ্রিল দুপুরের পর হিটলার ও তার নব পরিণীতা বধূ ইভা ব্রাউন আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর পর যাতে তাদের মৃতদেহ আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয় সে নির্দেশ দিয়ে যান। রাশানরা বাঙ্কারে প্রবেশ করে ২ মে, ১৯৪৫ তারিখে। কিন্তু হিটলার তখন আর জীবিত নেই। জার্মান শ্রেষ্ঠত্বের উগ্রবাদী দর্শনে বিশ্বাসী, পৃথিবীর অধিকর্তা হবার দুঃসাহসী স্বপ্নের জন্য কোটি কোটি মানুষকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেবার জন্য দায়ী হিটলারের মৃত্যু হলো কাপুরুষের মতো আত্মহননের মাধ্যমে। নিয়তির পরিহাস হয়ত এমনই হয়।



মুসোলিনি, হিটলারের মৃত্যু এবং জার্মান-জাপানসহ মিত্র শক্তিদের পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি হলেও বিশ্বে নতুন করে আরেকট যুদ্ধের সম্মুখীন হয়। আর তা হলো হলো Cold War বা স্নায়ুযুদ্ধ। এই স্নায়ুযুদ্ধের সময় কাল ১৯৪৭-১৯৯১ সাল পর্যন্ত হলেও তা এখনও ভিন্নভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে।


স্নায়ুযুদ্ধ হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রসমূহ এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্রসমূহের মধ্যকার টানাপোড়েনের নাম। ১৯৪০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৮০'র দশকের শেষ পর্যন্ত এর বিস্তৃতি ছিল। প্রায় পাঁচ দশকব্যাপী সময়কালে এই দুই শক্তিশালী দেশের মধ্যকার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও রাজনৈতিক মতানৈক্য আন্তর্জাতিক রাজনীতির চেহারা নিয়ন্ত্রণ করত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশসমূহ ছিল গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদের পক্ষে; আর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্র দেশসমূহ ছিল সাম্যবাদ বা সমাজতন্ত্রপন্থী। স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রধান মিত্র ছিল যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, জাপান ও কানাডা। আর সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে ছিল পূর্ব ইউরোপের অনেক রাষ্ট্র, যেমন বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, পূর্ব জার্মানি ও রোমানিয়া। স্নায়ুযুদ্ধের কিছুকাল যাবৎ কিউবা এবং চীন সোভিয়েতদের সমর্থন দেয়।


এই বিশেষ ঐতিহাসিক ঘটনাকে ইংরেজিতে Cold War কথাটি দিয়ে সর্বপ্রথম সূচিত করেন রুশ সাহিত্যিক জর্জ অরওয়েল, ১৯৪৫ সালে। বাংলায় নামটি স্নায়ুযুদ্ধ অথবা ইংরেজি নামের আদলে শীতল যুদ্ধ, ঠাণ্ডা লড়াই ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। বাংলায় এই নাম ব্যবহারের কারণ হলো, এ যুদ্ধে প্রতিপক্ষ দেশগুলো সরাসরি লড়াইয়ের মুখোমুখি না হয়ে একে অপরকে হুমকি, সামরিক ও পারমাণবিক শক্তি প্রদর্শন, মহাকাশ প্রতিযোগিতা, ছোটখাটো যুদ্ধে আধিপত্য বিস্তার ইত্যাদি উপায়ে পরাস্ত করতে চেয়েছিল। অর্থাৎ লড়াইগুলো কখনোই গরম বা ভয়াবহ হয়ে উঠেনি, সবসময় ঠাণ্ডা বা শান্তই ছিল। তবে শান্ত বা ঠাণ্ডা হলেও এগুলো ছিল চরম উত্তেজনাপূর্ণ।



দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পরাশক্তি বা সুপার পাওয়ার হিসেবে আবির্ভাব ঘটে।পরস্পরবিরোধী রাষ্ট্রজোট প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ না হয়ে পরস্পরের প্রতি যে যুদ্ধভাব বিরাজ করেছিল বা সংগ্রামে লিপ্ত ছিল তাকেই ঠাণ্ডা লড়াই বলে অভিহিত করা হয়। শীতল লড়াই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনাপর্ব; মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সমগ্র বিশ্ব দুইটি শিবিরে ভাগ হয়ে যায়। যথা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট এবং সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক শিবির।


এশিয়ার মাটিতে এই রেষারেষি বেশি প্রবল হয়ে ওঠে এবং পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ব্যাপক অনিশ্চয়তা ও রুদ্ধশ্বাস টানাপোড়েন এর জন্ম দেয় ফলে বিশ্বশান্তি বিনষ্ট হয়। ন্যাটো, সিয়াটোর পাশাপাশি রুশশক্তির গঠিত ওয়ারশ চুক্তি এই স্নায়ুযুদ্ধকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। জার্মানির বিভক্তিকরণ এবং ইউরোপীয় নিরাপত্তার সন্ধান এই সময়কালে অন্যতম বিষয় ছিল যা ঠান্ডাযুদ্ধ কর্তৃক প্রভাবিত হয় ফলে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে অবর্ণনীয় জটিলতার প্রসার ঘটায়। 



স্নায়ুযুদ্ধের কবলে পরে বলির পাঠা হয় কোরিয়া, ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান এবং মধ্যপ্রাচ্যে। পুঁজিবাদী আর সমাজতন্ত্রের যাতাকলে পরে কোরিয়া এবং ভিয়েতনাম দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলে কয়েক দশক ধরে। আর এদিকে আফগানিস্তানে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন রাশিয়া একচেটিয়া শোষণ করতে করতে দেশের কংকালসার অর্থনৈতিক অবস্থা করে দিয়ে গেছে।


আর মধ্যপ্রাচ্যের কথা আর কি বা বলবো। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর ফ্রান্স, স্পেন এবং ব্রিটেন মিলে ডমিনো তত্ত্বের প্রয়োগ ঘটিয়ে ভাগবাটোয়ারা করে নেয়। আর স্নায়ুযুদ্ধের সময় দেশগুলোর মাঝে গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দিয়ে একদিক থেকে আমেরিকা অস্ত্র বিক্রি করতেছে আর অন্যদিকে রাশিয়া। নিজেরা নিজেরা মুসলিম মরতেছে আর অস্ত্র বিক্রি করে আমেরিকা রাশিয়া ফুলে ভেপে বিশ্বের মোড়লের ভূমিকা পালন করতেছে।


স্নায়ুযুদ্ধ এতদিনে নিরবে চললেও ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার মধ্য দিয়ে একটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের রূপ নিতে যাচ্ছে। রাশিয়ার পাশে অকুণ্ঠ সমর্থন দিচ্ছে চিনসহ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আমেরিকা তীব্র নিন্দা প্রকাশ করেই ক্ষান্ত রয়েছে। অথচ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নিজে দেশ রক্ষার্থে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নেমেছে। এখন যদি এখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ শুধু বিবৃতিতের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে থাকে রাশিয়ার আগ্রাসনের শিকার হবে ইউক্রেনসহ বিভিন্ন ছোট ছোট রাষ্ট্র। আর যদি প্রতিবাদ স্বরূপ ন্যাটো সহ আমেরিকা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তাহলে ধরে নেওয়া যায় যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন।


এই ক্ষেত্রে মুসলিম দেশগুলোর ভূমিকা কি থাকবে! জাতিসংঘের কথা অনুযায়ী নাচবে নাকি ন্যায় অন্যায় বিবেচনা করে নিজেদের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নিবে?? 






















Comments

Popular posts from this blog

সমকাম বা হোমোসেক্সুয়াল

বিভিন্ন ধর্মে নারীর পর্দা- তৌহিদ রাসেল

এক নজরে দোহার উপজেলা