ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং আমেরিকার পরাজয় - তৌহিদ রাসেল

ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং আমেরিকার পরাজয়

- তৌহিদ রাসেল




১৯৬৪ সালে বিশ্বসেরা বক্সার হিসেবে চ্যাম্পিয়ন হন ক্যাসিয়াস ক্লে। তার ঠিক তিন বছর পর ১৯৬৭ সালের ২৮শে এপ্রিল বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন ক্যাসিয়াস ক্লে কে তলব করা হলো একটি সামরিক প্যানেলের সামনে। ক্যাসিয়াস ক্লে আর কেউ নন, তিনি হলেন সবার পরিচিত বিখ্যাত বক্সার মোহাম্মদ আলী। ইসলাম গ্রহণের আগে তার নাম ছিল ক্যাসিয়াস ক্লে।


টেক্সাসের হিউস্টনে ট্রাইব্যুনালের সামনে হাজির হলেন তিনি। যখন তাঁর নাম ঘোষণা করা হলো, তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেতে অস্বীকৃতি জানালেন। তাকে বলা হলো যে তাকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেতে হবে। তিনি বললেন - "কেন আমি নিজের দেশ থেকে দশ হাজার মাইল দূরে গিয়ে নিরপরাধ বাদামি মানুষদের ওপর বোমা আর গুলি চালাতে যাবো? যারা কিনা আমাদের কোন ক্ষতি করেনি? আমি সোজা বলতে চাই, আমি যাব না। নিরপরাধ মানুষদের হত্যা করতে আমি যাব না।"


স্নায়ু যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় সবচেয়ে যে দেশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা হলো ভিয়েতনাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পৃথিবী সম্মুখীন হয় নতুন একযুদ্ধের। যাকে বলা হয় স্নায়ু যুদ্ধ। এই যুদ্ধ হয় দুই মতবাদ সমাজতান্ত্রিক এবং পুজিবাদের মধ্য।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভিয়েতনামে ফ্রান্সের উপনিবেশ বজায় রাখতে ফ্রান্স বদ্ধপরিকর হয়ে উঠে। এদিকে ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট বিপ্লবী হো চি মিন ইন্দোচীন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর এবং ভিয়েতনামের গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র গঠনের ঘোষণা দেন।


হো চি মিন একাধিক ভিয়েতনামী জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী নিয়ে তৈরি করেন 'ভিয়েত মিন' নামক গেরিলা সংগঠন, যার অর্থ 'ভিয়েতনামের স্বাধীনতার জন্য লীগ'।


হো চি মিনের স্বাধীনতার ঘোষনার ফলে ফ্রান্স যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হয়। যার ফলে ফ্রান্স এবং ভিয়েতনামের মাঝে ১৯৪৬ সাল থেকে শুরু হয় 'ইন্দোচীন' নামক যুদ্ধ। 


ভিয়েতনামের মানুষের সমর্থনে ভিয়েত মিন ভিয়েতনামের বেশিরভাগ গ্রামীণ অঞ্চল দখল এবং নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিল যার ফলে ১৯৫৪ সালে ফরাসি পরাজয় ঘটে। সে বছর জেনেভা সম্মেলনে আলোচনার ফলে যুদ্ধের অবসান ঘটে এবং ভিয়েতনামের স্বাধীনতা স্বীকৃতি পায়। ১৭ ডিগ্রি দ্রাঘিমার সমান্তরালে অস্থায়ীভাবে দেশটিকে উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছিল। উত্তর অঞ্চলটি ডেমোক্রাটিক রিপাবলিক অফ ভিয়েতনাম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল এবং সাধারণত উত্তর ভিয়েতনাম নামে পরিচিত হয়ে ওঠে, ফরাসী-প্রতিষ্ঠিত ভিয়েতনামের নিয়ন্ত্রণাধীন দক্ষিণ অঞ্চলকে সাধারণত দক্ষিণ ভিয়েতনাম বলা হত।


জেনেভা চুক্তির বাস্তবায়নের তদারকি করার দায়িত্ব ছিল ভারত, কানাডা এবং পোল্যান্ডের সমন্বিত একটি আন্তর্জাতিক কমিশনের। ভারত নিরপেক্ষ, কানাডা অ-কমিউনিস্ট এবং পোল্যান্ড কমিউনিস্ট ব্লকের প্রতিনিধিত্ব করেছিল। ডোমিনো তত্ত্ব’ অনুসারে ভিয়েতনামে কমিউনিজমের প্রতিষ্ঠা গোটা এশিয়াতে সাম্যবাদের জোয়ার বয়ে আনবে- এমন ভয় পেয়ে জেনেভা চুক্তির সাথে সম্মত হলো না যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে লাগলেন দক্ষিণ ভিয়েতনামে আবারও নতুন সরকার গঠন করে ভিয়েতনামের ঐক্য ঠেকিয়ে দিতে। ওদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলমান স্নায়ু যুদ্ধ তখন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল। সোভিয়েতের সাথে মিত্রতা আছে এমন যে কারও প্রতি মার্কিন নীতি হয়ে উঠছিল কঠোরতর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ও সাহায্য নিয়ে ১৯৫৫ সালে দক্ষিণ ভিয়েতনামে এক ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে বাও দাইকে সরিয়ে দিয়ে প্রেসিডেন্ট হলো প্রচণ্ড কমিউনিস্ট বিদ্বেষী দিন দিয়েম নো। আর শত্রুর শত্রু বন্ধু, সেই নীতি অনুযায়ী সোভিয়েত মিত্র উত্তর ভিয়েতনামকে শত্রু পরিগণিত করা দক্ষিণ ভিয়েতনামের দিন দিয়েম সরকারকে বন্ধু বানিয়ে নিল যুক্তরাষ্ট্র। 


১৯৫৬ সালে নির্বাচন না হওয়ার কারণে ভিয়েত মিন গেরিলারা যুদ্ধের জন্য সক্রিয় প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ইতোমধ্যে ভিয়েত মিন নাম পরিবর্তন করে নতুনভাবে রাখা হয় ভিয়েত কং নামে। তারা আগের থেকেও অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা দক্ষিণ ভিয়েতনামে ছোট ছোট আক্রমণ শুরু করে।


মার্কিন সামরিক বাহিনী ও পুলিশের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলো দিন দিয়েমেরর বাহিনীর জন্য এবং এলো অস্ত্রশস্ত্রও। শুরু হলো এক দীর্ঘ রক্তাক্ত সময়ের। একদিকে হো চি মিনের উত্তর ভিয়েতনাম সমর্থন পায় চীন রাশিয়া সহ অন্যান্য কম্যুনিস্ট দেশের। আর দক্ষিণ ভিয়েতনামে খুটি গেড়ে বসে আমেরিকাসহ পুঁজিবাদী বলয়ের শক্তি। ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত চলে এক অমানবিক ধ্বংসালীলা।


আমরা খুব ছোটবেলা থেকে এই শব্দটার সাথে খুবই পরিচিত 'Money begets money'। ভিয়েতনামের যুদ্ধের টপিক সামনে আসলে বলতে হয় 'War begets war'। 


১৯৬০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে দক্ষিণ ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট মতাদর্শীদের সাথে অ-কমিউনিস্টরাও মিলিত হলো। সেই ঐক্যের ভিত্তি একটাই দিন দিয়েমের অন্যায় শাসনের অবসান ঘটানো। তারা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট নামের একটি সংগঠন গঠন করল। যদিও এনএলএফ নিজেদেরকে একটা স্বায়ত্তশাসিত সংগঠন বলেই দাবি করেছিল এবং এর সদস্য অধিকাংশ দক্ষিণ ভিয়েতনামীই ছিল অ-কমিউনিস্ট, তবুও জন এফ কেনেডির নেতৃত্বাধীন মার্কিন সরকার একে কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন উত্তর ভিয়েতনামের অধীনস্ত সংস্থা হিসেবেই ধরে নিল। এনএলএফ এর সদস্যদের ব্যঙ্গ করে ‘ভিয়েত কং’ বা ভিয়েতনামী কমিউনিস্ট হিসেবে চিহ্নিত করতে লাগল যুক্তরাষ্ট্র। 


১৯৬১ সালে দক্ষিণ ভিয়েতনামের ঐক্যপন্থীদের প্রতিহত করার জন্য সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানের সিদ্ধান্ত নিল মার্কিন প্রশাসন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশেও যদি সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে আরও অনেক দেশ তাদের অনুসরণের অনুপ্রেরণা পাবে- এমন ভয় থেকেই কেনেডি প্রশাসন যে কোনো মূল্যে ভিয়েতনামের একত্রীকরণ ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠল। ভিয়েতনামে ভিড়তে শুরু করল একের পর এক মার্কিন সৈন্যবাহী জাহাজ।


আমেরিকা সরাসরি দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষে মূল যুদ্ধ শুরু করে ১৯৬৫ সালে। কিন্তু এর আগেই তারা দক্ষিণ ভিয়েতনামে সামরিক সহায়তা করেছে অনেকভাবে। যখন আমেরিকা যুদ্ধে যোগ দেয়, তার আগেই প্রায় ১৬ হাজার মার্কিন সামরিক উপদেষ্টা অবস্থান করছিল ভিয়েতনামে। অসংখ্য সিআইএ অফিসারকে পাঠানো হয় ভিয়েত কংদের খোঁজখবর নেয়ার জন্য। ডোমিনো তত্ত্ব অনুসারে, যেহেতু একটি দেশ কমিউনিস্ট শাসনে চলে গেলে পুরো অঞ্চলটিতেই কমিউনিস্ট শাসন গোড়াপত্তন হওয়ার সুযোগ রয়েছে, তাই আমেরিকা সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে হলেও দক্ষিণ ভিয়েতনাম টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল।


১৯৬৫ সালে, অর্থাৎ যুদ্ধে মার্কিনীদের সরাসরি অংশগ্রহণের সময় থেকেই মার্কিন যুদ্ধকৌশলের মূলনীতি ছিল 'অ্যাট্রিশন'। এই পদ্ধতির মূল বৈশিষ্ট্য হলো, সরাসরি আক্রমণের মাধ্যমে শত্রুপক্ষকে এমনভাবে ধসিয়ে দেয়া, যাতে তারা আবার কোনো প্রতিআক্রমণ পরিচালনা করতে না পারে। এই কৌশলে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, শত্রুপক্ষকে এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে হবে, যাতে তারা নতুন করে প্রস্তুতি নেয়ার সময় না পায়। ভিয়েতনামে মার্কিন আক্রমণে যে পরিমাণ ভিয়েত কং মারা যাচ্ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ প্রাপ্তবয়স্ক যুবককে প্রতি বছর উত্তর ভিয়েতনামের সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হচ্ছিল। আর অনবরত বোমা হামলার মাধ্যমে অবকাঠামোগত ক্ষতি করা হয়েছিল উত্তর ভিয়েতনামে, তা দ্রুত কাটিয়ে উঠেছিল ভিয়েত কংরা। এমনও হয়েছে, ধসে যাওয়া একটি ব্রিজকে এক রাতের মধ্যেই আবার ব্যবহার উপযোগী করে ফেলা হয়েছে।


আমেরিকার বিপরীতে উত্তর ভিয়েতনাম যে সামরিক যুদ্ধকৌশল গ্রহণ করেছিল, তা হচ্ছে 'এনার্ভেশন'। এই কৌশলে নিজেদের যতটা সম্ভব টিকিয়ে রেখে যুদ্ধের সময়ের ব্যাপ্তি বাড়িয়ে শত্রুপক্ষের যুদ্ধ করার ধৈর্য শেষ করে দিতে হয়, শত্রুকে সরাসরি আক্রমণ না করে গেরিলা কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। উত্তর ভিয়েতনামের জন্য এই কৌশল খুবই কার্যকরী হয়েছিল।


যুদ্ধের সময়সীমা বেড়ে যাওয়ায় ও কার্যকরী কোনো ফলাফল আসার সম্ভাবনা দেখা না পাওয়ায় আমেরিকার জনগণ ও গণমাধ্যম ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিপরীতে অবস্থান নেয়। দিনে দিনে মৃত আমেরিকান সৈন্যদের কফিন যতই মার্কিন বিমানবন্দরে ভিড়তে থাকে, ততই সরকারের সমালোচনা বাড়তে থাকে।


অপারেশন রোলিং থান্ডার' নামে বোমাবর্ষণের যে মিশন পরিচালনা করেছিল মার্কিনীরা, তা ছিল ভিয়েতনামের জনমতের সম্পূর্ণ বিপরীত। আমেরিকানরা বেসামরিক জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করার ফলে দক্ষিণ ভিয়েতনামের যেসব সাধারণ মানুষ মার্কিনীদের পক্ষে ছিল, তারাও পক্ষত্যাগ করে। আর উত্তর ভিয়েতনাম অবকাঠামোগতভাবে তেমন উন্নত না থাকায়, শুধু বোমাবর্ষণ করে শত্রুপক্ষের ক্ষতি করা যায়নি।


আমেরিকার কার্পেট বোম্বিংয়ে শুধু বেসামরিক হতাহতের সংখ্যাই বেড়েছে, ভিয়েত কংদের তেমন ক্ষতি করতে পারেনি; ভিয়েত কংদের জন্য যুদ্ধটি ছিল স্বদেশ বাঁচানোর লড়াই। তাই ব্যাপক হারে মার্কিন বাহিনীর হাতে মারা যাওয়ার পরেও তারা রণেভঙ্গ দেয়নি, লড়াই জারি রেখেছিল সব সময়। মার্কিন সৈন্যদের এখানে দেশপ্রেমের কোনো বিষয় ছিল না। তাদের নীতি-নৈতিকতার স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল একসময়। সিআইএ রিপোর্ট করে, ভিয়েত কংদের কাছ থেকে জব্দ করা মোট সামরিক অস্ত্রশস্ত্রের প্রায় ৩১ শতাংশ ছিল মার্কিনিদের তৈরি।


উত্তর ভিয়েতনামের আরেকটি বড় নির্ধারক কৌশল হলো প্রথাবিরোধী গেরিলা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়া। অতর্কিত আক্রমণ করে নিরাপদ জায়গায় পালিয়ে যাওয়া এ কৌশলে আমেরিকানরা নাস্তানাবুদ হতে শুরু করে, প্রচুর সৈন্য মারা পড়তে শুরু করে ভিয়েত কংদের হাতে। কোরীয় উপদ্বীপের যুদ্ধে আমেরিকানরা যে সরাসরি আক্রমণে কৌশল প্রয়োগ করেছিল, তা অব্যাহত রেখেছিল ভিয়েতনামে এসেও। কিন্তু ভিয়েতনাম ছিল সবদিক থেকেই কোরিয়ার চেয়ে আলাদা। গেরিলা আক্রমণ প্রতিহত করার কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় মার্কিন বাহিনী ভিয়েতনামে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে।


ব্যাপক ধ্বংসলীলা চলার পর ১৯৭৫ সালের এপ্রিলের শেষে, এআরভিএন মেকং ব-দ্বীপ বাদে সমস্ত ফ্রন্টে ভেঙে পড়েছিল। মূল সাম্যবাদী হামলার আগে হাজার হাজার শরণার্থী দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছিল। ২৭ এপ্রিল ১০০,০০০ পিএভিএন সেনা সাইগনকে ঘিরে রাখে। শহরটি প্রায় ৩০,০০০ এআরভিএন সৈন্য দ্বারা রক্ষা করা হয়েছিল। ধ্বস এবং তীব্র আতঙ্কে, পিএভিএন টান সোন নাট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আশ্রয় নেয় এবং এটি বন্ধ করতে বাধ্য করে।


ঐতিহাসিক দক্ষিণ ভিয়েতনামি কর্মকর্তা ও বেসামরিক নাগরিকরা সাইগন ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য বিশৃঙ্খলা, অশান্তি ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সামরিক আইন জারি করা হয়েছিল। মার্কিন হেলিকপ্টারগুলি শহরের বিভিন্ন অঞ্চল এবং মার্কিন দূতাবাস প্রাঙ্গণ থেকে দক্ষিণ ভিয়েতনামি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিদেশী নাগরিকদের সরিয়ে নিতে শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কারণে অপারেশন ফ্রিকোয়েন্ট উইন্ড শেষ সম্ভাব্য মুহূর্ত পর্যন্ত বিলম্বিত হয়েছিল। রাষ্ট্রদূত গ্রাহাম মার্টিনের বিশ্বাস যে সাইগনে অবরোধ ঘটতে পারে এবং রাজনৈতিক সমঝোতায় আসতে পারে। 


ফ্রিকোয়েন্ট উইন্ড ছিল ইতিহাসের বৃহত্তম হেলিকপ্টার থেকে বোমাবর্ষণের ঘটনা। ২৯ এপ্রিল এটি শুরু হয়েছিল, যেহেতু ভিয়েতনামিদের ঐতিহাসিক জনতা সীমিত স্থানের জন্য অপেক্ষা করেছিল। আকাশসীমায় ফ্রিকোয়েন্ট উইন্ড চলতে থাকে, অন্যদিকে পিএভিএন ট্যাঙ্কগুলি সাইগনের নিকট প্রতিরক্ষা লঙ্ঘন করে। ৩০ এপ্রিল ভোরের দিকে, বেসামরিক নাগরিকদের ভিড় সরিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেরনাররা হেলিকপ্টারের সাহায্যে দূতাবাসটি স্থানান্তর করেছিল।


১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল, পিএভিএন সেনারা সাইগন শহরে প্রবেশ করে এবং দ্রুত সমস্ত প্রতিরোধকে পরাভূত করে, মূল ভবন এবং স্থাপনাগুলি আটক করে। স্থানীয় সময় সকাল ১১:৩০ নাগাদ ৩০৪তম বিভাগের একটি ট্যাঙ্ক ইন্ডিপেন্ডেন্স প্যালেসের ফটক বিধ্বস্ত করেছিল এবং এর উপরে ভিয়েত কংয়ের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। দু'দিন পূর্বে হুংয়ের স্থলাভিষিক্ত হওয়া রাষ্ট্রপতি ডাং ভান মিন, কর্নেল বৌ টানের নিকট আত্মসমর্পণ করেছিলেন।


এভাবে ব্যাপক ধ্বংসলীলা আর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে দিয়ে ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল মার্কিনরা ভিয়েতনামে পরাজিত বরণ করে ভিয়েতনাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্স এবং পরবর্তীতে আমেরিকার সাথে চলা সর্বমোট প্রায় ৩০ বছরের যুদ্ধের অবসান হয়ে ভিয়েতনামের বুকে স্বাধীনতার সূর্য উঠে।


ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার হারের অনেকগুলো কারণ ছিল। কারণগুলো তুলে ধরা হলো-


কমিউনিস্টদের বিরােধিতা: ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ভিয়েতনামে দিয়েম সরকারকে সমর্থন করে ভুল করেছিল । কারণ , এই সরকারের বিরােধী কমিউনিস্টরা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী । তারা ভিয়েত কং ও জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট ( National Liberation Front ) – এর সঙ্গে মিলিত হয়ে মার্কিনিদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলে । 


ভিয়েতনামিদের তীব্র স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা: ভিয়েতনামিরা নিজেদের দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে লড়াই করেছিল। তাদের এই তীব্র স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষার কাছে হার মানতে হয়েছিল বিদেশি মার্কিনিদের। স্বাভাবিকভাবেই অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ের কাছে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী ছিল। যুদ্ধ যত এগিয়েছে মানসিকভাবে মার্কিনিরা ততই পিছিয়ে পড়েছে। 


গেরিলা রণকৌশল: ভিয়েতনাম মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা যুদ্ধ পদ্ধতিতে মার্কিনিদের থেকে এগিয়েছিল। শুধুমাত্র আকাশ থেকে বােমাবর্ষণ করে মার্কিন সেনাবাহিনী ভিয়েতনামি সেনাদের ধ্বংস করতে পারেনি। 


অজানা পরিবেশ: মার্কিন সেনাবাহিনী মাতৃভূমি ছেড়ে সম্পূর্ণ অজানা , অচেনা পরিবেশে লড়াই করতে এসেছিল । তাই চেনাজানা পরিবেশে ভিয়েতনামি সেনারা সহজে যেভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করতে পেরেছিল মার্কিনিরা সেভাবে পারেনি । 


বিশ্বজনমত: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিতে যতগুলি বােমাবর্ষণ করা হয়েছিল তার তিনগুণেরও বেশি বােমা ভিয়েতনামের ওপর নিক্ষেপ করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাই বিশ্বজনমত সম্পূর্ণভাবে মার্কিনিদের বিরুদ্ধে চলে যায়। ফলে ভিয়েতনাম থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। 


সোভিয়েত ও চীনের ভূমিকা: সোভিয়েত রাশিয়া ও চীন সাম্যবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ ভিয়েতনামকে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্রসহ সামরিক সাজসরঞ্জাম নিয়মিত জোগান দিয়েছিল। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিপুল সংখ্যক সেনা এই যুদ্ধে নিয়ােগ করলেও সফল হতে পারেনি।


ভৌগোলিক দূরত্ব: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভিয়েতনামের ভৌগােলিক দূরত্ব ছিল কয়েক হাজার মাইল । এতদূর থেকে যুদ্ধকে নিয়ন্ত্রণ করে সফল হওয়া ছিল অসম্ভব। তাই শেষ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের যুদ্ধ থেকে পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছিল।


ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকা এবং ভিয়েতনাম উভয়েরই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আমেরিকার চেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয় ভিয়েতনাম এবং তার আশেপাশের দেশসমূহ।


শুধু ১৯৬৯ সালেই ১০ লাখ ৩৪ হাজার ৩০০ হেক্টর বনভূমি ধ্বংস করা হয়। এ ছাড়া এই যুদ্ধে আমেরিকা ‘এজেন্ট অরেঞ্জ’ নামে এক ধরনের রাসায়নিক পর্দাথ ব্যবহার করে। এজেন্ট অরেঞ্জ হচ্ছে এমন এক ধ্বংসাত্মক রাসায়নিক পদার্থ যার ক্ষতিকর প্রভাব শুধু প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানে পড়ে না, বরং মানব জীবনেও রয়েছে এর ভয়ঙ্কর প্রভাব। ভিয়েতনামে এখনো অনেক শিশু আজন্ম খোঁড়া, অন্ধ এবং ত্বকের মারাত্মক রোগ নিয়ে জন্মাচ্ছে।


দক্ষিণ ভিয়েতনামের পতনের পর থেকে কম্যুনিস্ট সরকার এখানে তাদের তথাকথিত ‘Re-education’ প্রোগ্রাম এবং অর্থনৈতিক অবস্থা পুনর্গঠনের লক্ষ্যে ‘New Economic Zone’ চালু করে। ফলে সাধারণ মানুষকে কাজের জন্য অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করা হয়। তাদের এই অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগে উভয় দিকে তাদের বিরুদ্ধে জনগণ ঘৃণার আগুন ছড়াতে থাকে। চাপ সহ্য করতে না পেরে অনেকেই দক্ষিণ ভিয়েতনামের এসব ক্যাম্প থেকে পালায়ন করে অন্যদেশে উদ্বাস্তুর মতো জীবনযাপন করে। আবার অনেকেই সমুদ্র পথে পালিয়ে যাওয়ার সময় ডুবে মারা যায়। এভাবে সমুদ্র পার হতে গিয়ে তিন থেকে চার লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। আজ ভিয়েতনাম স্বাধীনতার এত দশক পরেও উন্নয়নশীল দেশের তালিকায়, কম্যুনিস্ট শাসনে ক্ষমতাসীনদের ভাগ্য বদলালেও তাদের অভাগা জনগণের ভাগ্য আর বদলায় না।


১৯৬৫ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে আমেরিকার বিমান বাহিনীর সদস্যরা ভিয়েতনামে ৮ মিলিয়ন টন বোমা নিক্ষেপ করে। আমেরিকার সৈন্যরা Operation Linebacker IILasting (18-29 December,1972)-এর মাধ্যমে উত্তর ভিয়েতনামের মূল অবকাঠামো ধ্বংস করে ফেলে। আমেরিকার সৈন্যরা ১৯৬২-১৯৭১ সালের মধ্যে শুধু দক্ষিণ ভিয়েতনামে ২০ মিলিয়ন গ্যালন হারবিসাইডস নামক এক ধরনের রাসায়নিক  ব্যবহার করে। যাতে করে দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সেইগনের উত্তরে এবং লাওস ও কম্বোডিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকায়  ঘন গাছপালা ধ্বংস করে খুব সহজেই ভিয়েত কং গেরিলাদের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা যায়।


এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে দুই মিলিয়নের বেশি মানুষ মারা যায়। এর মধ্যে অনেক নিরপরাধ নারী ও শিশু রয়েছে এবং তিন মিলিয়নের বেশি মানুষ আহত হয়। যুদ্ধে উভয় ভিয়েতনাম ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। এই যুদ্ধে শুধু আমেরিকার ৩৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হয় যার বর্তমানে দাঁড়ায় ১৮৫০বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা পরে আমেরিকার ভোটাভুটির রাজনীতিতে বড় ধরনের ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়।


যুদ্ধে উত্তর ভিয়েতনামের ১১ লাখ ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের দুই থেকে তিন লাখ সৈন্য মারা যায়। ৫৮ হাজার ২০০ আমেরিকার সৈন্য, দক্ষিণ কোরিয়ার ৪,০০০, অস্ট্রেলিয়ার ৫০০, থাইল্যান্ডের ৩৫০ এবং নিউজিল্যান্ডের তিন ডজনের মতো সৈন্য মারা যায়। যুদ্ধ শেষ হলেও ভিয়েতনামের সাত লাখ সৈন্য দীর্ঘদিন মানসিক সমস্যায় ভোগে।


এটাই ছিল আমেরিকার একমাত্র পরাজয় বরণ করা যুদ্ধ, এই যুদ্ধে আমেরিকার সৈন্যদের ব্যাপক আকারে মনোবল ভেঙে পড়ে। দেড় লাখ যুদ্ধাহত সৈনিক দীর্ঘদিন কষ্ট বয়ে বেড়ায়। অবশেষে ১৯৯৫ সাল থেকে পুনরায় ভিয়েতনামের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক চালু হয় যুক্তরাষ্ট্রের।


পক্ষান্তরে, উত্তর ভিয়েতনাম এই যুদ্ধের মাধ্যমে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় নিজেদের সামরিক সক্ষমতার প্রমাণ দিতে পারলেও জীবন ও সম্পদের যে ক্ষতি হয়েছে, তা কোনো দিন পূরণ হয়নি। এখনো কৃষি জমিতে স্থল মাইন পাওয়া যায়। হাজার হাজার একর জমি অনাবাদি পড়ে আছে রাসায়নিক বোমার বিরূপ প্রতিক্রিয়ায়। 


অথচ যেখান থেকে একদিন সোনার ফসল নিয়ে কৃষক বাড়ি ফিরত, একসময় মাতৃগর্ভ থেকে চাঁদের মতো ফুটফুটে বাচ্চা বেড়িয়ে আসতো। আজ হয়তোবা সেখান থেকে আজন্ম খোঁড়া অথবা জন্মান্ধ অথবা অন্য কোনো মহামারী নিয়ে মানবজাতির বোঝা হয়ে এই ধরণীর বক্ষে আসতে হচ্ছে তাদের।


হার্বাট হুবার বলেছিলেন-

'বয়জ্যেষ্ঠরাই যুদ্ধ ঘোষণা করে, কিন্তু লড়তে এবং মরতে হয় তরুণদেরকেই।'

Comments

Popular posts from this blog

সমকাম বা হোমোসেক্সুয়াল

বিভিন্ন ধর্মে নারীর পর্দা- তৌহিদ রাসেল

এক নজরে দোহার উপজেলা