আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট পর্যালোচনা - তৌহিদ রাসেল
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট পর্যালোচনা
- তৌহিদ রাসেল
বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট কোন রাজার সাথে যুদ্ধে কুলাইতে না পেরে পিছু হটেছিলেন??
উত্তর-
যে রাজার সাথে যুদ্ধে কুলাইতে না পেরে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট পিছু হটেছিলেন ধ্রুপদী গ্রিক ও ল্যাটিন বর্ণনায় সে রাজার নাম আগ্রাম্মেস। তিনি ছিলেন নীচকূলোদ্ভব নাপিতের পূত্র। হিন্দু পুরাণে তিনি মহাপদ্মনন্দন এবং বৌদ্ধ শাস্ত্র মাহাবোধিবংশে উগ্রসেন, অর্থ এমন এক ব্যক্তি যাঁর ‘প্রকান্ড ও পরাক্রান্ত সেনাবাহিনী’ আছে।
সেই রাজার প্রকান্ড সেনাবাহিনী বর্ণনার ক্ষেত্রে ভারতীয় ও ধ্রুপদী ইউরোপীয় রচনাগুলির উল্লেখে প্রচুর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ডিওডোরাস ও ক্যুইন্টাস কার্টিয়াস রুফাস উভয়েই উল্লেখ করেছেন সেনাবাহিনীর বিভিন্ন বিভাগ সম্বন্ধে। যথা- পদাতিক সৈন্য ২ লক্ষ, অশ্বারোহী সৈন্য ২০ হাজার, রথ ২ হাজার, এবং তিন থেকে চার হাজার হাতি।
আলেকজান্ডারের পিছু হটা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মাঝে কিছু মতভেদ রয়েছে। কিছু ঐতিহাসিক বলেছেন তিনি যুদ্ধ করেন নি, যুদ্ধ না করেই তিনি ভারত ত্যাগ করেন। কারণ, তার সেনাবাহিনী যুদ্ধ করতে আর আগ্রহী ছিল না। তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে চাচ্ছিলো।
কিন্তু কিছু ঐতিহাসিক বলেছেন আলেকজান্ডার রাজা আগ্রাম্মেসের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন এবং যুদ্ধে তিনি আহত হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হন। কারন, রাজা আগ্রাম্মেসের হস্তীবাহিনীর সাথে তাদের পেরে উঠা সম্ভব ছিল না।
এখন কোনটা ঠিক বা বেঠিক তা বলা মুশকিল। কারন এ ব্যাপারে তেমন জুড়ালো কোনো প্রমাণাদি পাওয়া যায়নি। তবে এটা সত্য যে তিনি অসুস্থ হয়ে ফিরে যান। এখন অসুস্থ কি যুদ্ধে আহত হয়ে নাকি অন্য কারনে সেটাই ঘোলাটে রয়ে গেছে।
অলিভার স্টোন ইতিহাস বিশ্লেষণ করে 'Alexander 2004' মুভিটি তৈরি করেন এবং সেখানে তিনি দেখিয়েছেন যে আলেকজান্ডার রাজা আগ্রাম্মেসের সাথে যুদ্ধ করেছেন এবং যুদ্ধে তিনি আহত হন। তবে যে যাই বলুক এই কথা সত্য যে রাজা আগ্রাম্মেস ছিলেন খুবই শক্তিশালী।
এখন কথা হলো রাজা আগ্রাম্মেসের রাজ্যের নাম কি? এটা শুনার পর একটু অন্য রকম ভাল লাগা কাজ করবে। কারন, নিজের গৌরবের গল্প কার না শুনতে ভাল লাগে!
সেই রাজা আগ্রাম্মেসের রাজ্যের নাম গ্রিকরা বলতেন গঙ্গারিডাই এবং স্থানীয় মানুষেরা বলতো গঙ্গারিদ্ধি। এই গঙ্গারিদ্ধি অন্য আর কিছু না, এটা আমাদের বঙ্গ অঞ্চল। অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ।
ইতিহাসবিদ ডিওডোরাস গঙ্গারিডাই রাজ্য এবং যুদ্ধে লিপ্ত নিয়ে বলতে গিয়ে লিখেছেন- ‘ভারতের সমূদয় জাতির মধ্যে গঙ্গারিডাই সর্বশ্রেষ্ঠ। এই গঙ্গারিডাই রাজার সুসজ্জিত ও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত চার হাজার হস্তী-বাহিনীর কথা জানিতে পারিয়া আলেকজান্ডার তাহার বিরূদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হইলেন না’
আলেকজান্ডারের সেনাপতি ও বন্ধু সেলুকাসের রাজত্বকালে গ্রিক একজন দূত ভারতে এসেছিল। তিনি লিখেন- ‘গঙ্গারিডাই রাজ্যের বিশাল হস্তী-বাহিনী ছিল। এই বাহিনীর জন্যই এ রাজ্য কখনই বিদেশি রাজ্যের কাছে পরাজিত হয় নাই। অন্য রাজ্যগুলি হস্তী-বাহিনীর সংখ্যা এবং শক্তি নিয়া আতংকগ্রস্ত থাকিত’
সেলুকাসের নাম যেহেতু চলে আসলো সেহেতু তাকে নিয়ে অর্থা সেলুকাস শব্দ নিয়ে বাঙ্গালিদের একটা ভুল জ্ঞান আছে।
" 'বিচিত্র এ দেশ! সেলুকাস!' - শিরোনামে কোন একটা পত্রিকায় একটা কলাম ছিল। আমরাও হর হামেশা বলে থাকি -
কী বিচিত্র! সেলুকাস!
কী অদ্ভুত! সেলুকাস!
কিন্তু এ সেলুকাস এর মানে কি?
এমনি অভিধানে সেলুকাসের কোন অর্থ নেই। এই শব্দটা অদ্ভুত, বিচিত্র প্রভৃতি অর্থ প্রকাশে ব্যবহৃত হয়।
‘সেলুকাস (Seleucus) ছিলেন একজন গ্রীক বীর যোদ্ধা, আলেকজান্ডারের সেনাপতি, এবং আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর সফল শাসক। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭ সালে আলেকজান্ডারের ভারত দখলের অভিযানে প্রধান সেনাপতি হিসেবে তার অবস্থান ইতিহাসে পাওয়া যায়। সিন্ধু উপত্যকা দিয়েই তারা ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করে।
ইউরোপ থেকে আসা এই দল ইরান-আফগানিস্তান এলাকা পার হয়ে ভারতে এলে এখানকার মানুষের গঠন, চালচলন, কৃষ্টি, সভ্যতা ইত্যাদির ভিন্নতা ও বিচিত্রতা দেখে অবাক ও বিস্মিত হয়। অনেকেই ধারনা করেন এই বৈচিত্র দেখেই সিন্ধু নদের তীরে দাড়িয়ে ঐ সেনাপতিকে উদ্দেশ্য করে সম্রাট আলেকজান্ডার কোন হতাশামূলক উক্তি করেছিলেন।
হতে পারে এরকম "সত্যি সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ" যেমন আমরা বলি "হায়! কি বিচিত্র এই দেশ" সেলুকাস বলতে "হায়" শব্দের সমর্থক শব্দ বোঝানো হলেও এ ব্যাপারে পরিষ্কার করে কোথাও কিছু বলা নেই।’
আরেকটি সূত্র বলে-
‘গ্রীক ভাষায় আলেকজান্ডার সেলুকাসকে কি বলেছিলেন তা জানা না গেলেও(সম্ভবত) দিজেন্দ্রলাল রায় তার একটি লেখায় আলেকজান্ডারের এই মুহূর্তটির অনুভুতি সম্পর্কে লিখেছেন “সত্যিই সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!” সেই থেকে বাংলা ভাষায় এই বাক্যটির প্রচলন, তবে আলেকজান্ডারের অনুভুতিটুকু (হয়তোবা) প্রশংসার বহিঃপ্রকাশ হলেও কালের বিবর্তনে আমরা এটিকে অবাস্তব, অসম্ভব, অসহনীয় বা আজগুবি অবস্থার উদ্ভবেই বেশী ব্যবহার করে থাকি।' "
এভাবে বলা যায়- ধরেন, আপনি আমি কোনো এক দেশে বেড়াতে গেলাম আপনি অবাক করা কিছু জিনিস দেখে বললেন যে, 'সত্যি তৌহিদ, কি বিচিত্র এই দেশ! একই ভাবে হয়তো আলেকজান্ডার তার সেনাপতি সেলুকাসকে বলেছিল।
সেলুকাসকে নিয়ে যেহেতু কথা শুরু হয়েছে তাহলে সেলুকাসকে নিয়ে আরো দুই এক লাইন লেখা যায়।
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর ব্যাক্ট্রিয়া ও সিন্ধু নদ পর্য্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অংশ সেনাপতি সেলুকাসের অধিকারে আসে। ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন।
এই সংঘর্ষের সঠিক বর্ণনা পাওয়া যায় না, কিন্তু যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সেলুকাস তাঁকে আরাখোশিয়া , গেদ্রোসিয়া ও পারোপামিসাদাই ইত্যাদি সিন্ধু নদের পশ্চিমদিকের বিশাল অঞ্চল অঞ্চল সমর্পণ করতে এবং নিজ কন্যাকে তাঁর সাথে বিবাহ দিতে বাধ্য হন।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তির পর প্রথম সেলুকাস পশ্চিমদিকে প্রথম আন্তিগোনোস মোনোফথালমোসের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। চন্দ্রগুপ্ত সেলুকাস ৫০০টি যুদ্ধ-হস্তী দিয়ে সহায়তা করেন। যা ইপসাসের যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। তাঁকে জয়লাভে সহায়তা করে।
প্রশ্ন যেহেতু আলেকজান্ডারকে নিয়ে ছিল সেহেতু আমরা আবার তার দিকে ফিরে আসি। পুরু নামের এক রাজার সাথে আলেকজান্ডারের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পুরু পরাজিত এবং বন্দি হয়। তাকে নিয়ে আসা হয় আলেকজান্ডারের সামনে। তার পরের ইতিহাস সবার জানা। বন্দী নৃপতিকে সামনে নিয়া আসা হলে তাকে আলেকজান্ডার জিজ্ঞেস করেন,
'কেমন ব্যাবহার প্রত্যাশা করেন তিনি?'
রাজকোচিত মর্যাদার সাথে পুরু উত্তর দিলেন,
'একজন রাজা আর একজন রাজার কাছে যে ব্যাবহার আশা করে তার মতো।'
আলেকজান্ডার উত্তর দিলেন 'যাও তুমি মুক্ত', পরে ওই পুরু আলাকজান্ডারের খুব ভাল বন্ধুতে পরিনত হন।
বিভিন্ন ধর্মে আলেকজান্ডার বা তার সাথে তুলনীয় সমসাময়িক ব্যক্তির উল্লেখ পাওয়া গেছে। এসব নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিভিন্ন মতামত প্রচলিত আছে। পবিত্র কুরআন শরীফে উল্লিখিত জুলকারনাইন ই আলেকজান্ডার ছিলেন কী না তা নিয়েও মতপার্থক্য আছে।
আলেকজান্ডারকে নিয়ে লেখালিখি করব বলে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে আলেকজান্ডারকে নিয়ে লেখা আর্টিকেল গুলি পড়েছিলাম। একটি ইসলামিক ওয়েবসাইটের একটা জিনিস পড়ে পুরাই তাজ্জব হইয়া গেলাম। সেখানে লেখক সরাসরি আলেকজান্ডারকে কাফের বলেছেন।
আমি বুঝলাম না তিনি কোন দৃষ্টি কোন থেকে কাফের বলেছেন। তবে আমি একটা কারন দাড় করিয়েছি সেটা হলো তিনি ভাবছেন যে আলেকজান্ডার যেহেতু গ্রীকের লোক ছিল সেহেতু রাসুল (সাঃ) পরবর্তী যুগ থেকে প্রায় আজ অবধি গ্রিকের সকল শাসক ছিলেন অন্য ধর্মের। সুতরাং সেহেতু সেই দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি হয়তো তাকে কাফের বলেছেন।
কিন্তু আসল কথা হলো আলেকজান্ডারের শাসন কাল ছিল রাসুল (সাঃ) এর সাড়ে আটশত বছর আগে এবং ঈসা (আঃ) এর জন্মের প্রায় তিন শত বছর আগে। আর আল্লাহ রাসুল (সা:) এর আগে অনেক নবী রাসুল দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন।
আলেকজান্ডারের এমন কোনো লেখা বা কথা পাওয়া যায়নি যে যেখানে তিনি স্রষ্টার বিরোদ্ধে কথা বলেছেন। এমনও তো হতে পারে যে তৎকালিন সময়ে গ্রীকে নবী ছিল এবং তিনি সেই নবীকে মেনে চলেছেন। সে কি ছিল সেটা আল্লাহ ভাল জানেন। আমি আপনি কাউকে নিয়ে কিছু বলার আগে অবশ্যই তার সমন্ধে জ্ঞান রাখতে হবে। এমন না যে আমি তার পক্ষে সাফাই গাইতেছি। তিনি কোনো নবীর অনুসারী হতেও পারেন আবার না হতেও পারেন। আল্লাহ তা'আলা লাখের উপর নবী দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন।
আল্লাহ কুরআনে বলেছেন-
'এবং নিশ্চয় আমি আপনার পূর্বে অসংখ্য রসূল প্রেরণ করেছি, যাঁদের মধ্যে কারও কারও অবস্থাদি আপনার নিকট বর্ণনা করেছি আর কারও কারও অবস্থাদি বর্ণনা করিনি।'
[সূরা মু’মিনঃ৭৮]
একদিন একজনের সাথে আলোচনা করিতেছিলাম যে, নবী ও রাসুল কাদের বলে এবং তাদের মধ্যে পার্থক্য কি এই বিষয়ে। কথা বলার পরিপ্রেক্ষিতে একবার আমি তাকে বললাম, 'ভাই আপনি কি মানেন ভারতবর্ষেও আল্লাহ তা'আলা নবী পাঠিয়েছিল?'
এই কথা শুনে সে তো পুরাই ক্ষেপে গেলো এবং বললো, 'রাসেল ভাই আপনি মনে হয় কাদিয়ানীদের পক্ষে কথা বলতেছেন'
মজার ব্যাপার হলো তখন আমি নিজেও জানতাম না কাদিয়ানী কারা। পরে জেনেছিলাম যে কাদিয়ানী হলো রাসুল (সা:) কে যারা শেষ নবী মানেনা এবং ভারতের মির্যা গোলাম আহমদকে নবী হিসেবে মানে। কাদিয়ানীরা যে বিভ্রান্ত সেটা ইসলামের সাধারণ জ্ঞান থাকলেই জানা যায়। কারন, কুরআনে স্পষ্টভাবে বলা আছে রাসুল (সা:) হলেন সর্বশেষ নবী।
যাহোক, আমি তাকে রাসুল (সা:) এর আগে প্রাচীন যুগের ভারতবর্ষের কথা কথা বুঝাইয়া বললাম। কিন্তু সে কিছুতেই আমার সাথে একমত হতে রাজি না। আমি কিছুতেই তাকে বুঝাইতে পারলাম না যে রাসুল (সাঃ) এর আগে প্রাচীন ভারতবর্ষে আল্লাহ তা'আলা নবী পাঠিয়েছিল। শেষমেশ ব্যর্থ হয়ে তাকে বললাম, ভাই আপনি আমাকে কুরআনের সুরা আল ফাতিরের ২৪ নং আয়াত যেখানে আল্লাহ বলেছেন- 'এমন কোন সম্প্রদায় নেই যেখানে সতর্ককারী আসেনি' এই কথা টার ব্যাখ্যা আমাকে বুঝিয়ে দিন। পরে তিনি নিজেই চিন্তা করতে লাগলেন এবং অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে এসে কিছুক্ষণ কথা বলে চলে গেলেন।
সুরা আল ফাতিরের ২৪ নং আয়াত এবং সুরা মু'মিনের ৭৮ নং আয়াত অনুসারে বলা যায়, আল্লাহ তা'আলা প্রাচীন গ্রীকেও নবী পাঠিয়েছিলেন।
আধুনিক যুগের গবেষক ও পন্ডিতদের মতে কুরআনে উল্লিখিত জুলকারনাইনের মাধ্যমে ঐতিহাসিক সম্ভাব্য ৩ টি চরিত্র নির্দেশ করা যেতে পারে। তারা হলেন-
১. মহামতি আলেকজান্ডার,
২. সাইরাস দি গ্রেট,
৩. হিমায়ার সাম্রাজ্যের একজন শাসক।
আলেকজান্ডারকে ফারসি ভাষায় ইস্কান্দর, আরবে আল ইস্কান্দার আল কাবের, উর্দুতে সিকান্দার-এ আজম, পস্তুতে স্কান্দর, হিব্রুতে আলেকজান্ডার মোকদন, আরমেনিয়ানয়ে ট্রে-কারনাইয়া।
তার এজাতীয় কিছু নামের অর্থ 'দুই শিং বিশিষ্ট' এবং কুরআনে উল্লেখিত জুলকারনাইনের বাংলা অর্থও তাই অর্থাৎ দুই শিং বিশিষ্ট, আবার উর্দু ও হিন্দিতে সিকান্দার যার অর্থ পারদর্শি বা অত্যন্ত পারদর্শি। বাইবেলে তাকে শৃঙ্গধারী সম্রাট বলা হয়েছে।
গ্রিকদের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে আলেকজান্ডার যখন পারস্য জয় করেন তখন পারস্য শহরে ঢোকার সময় পারস্যের মানুষ তাকে 'সিকান্দার! সিকান্দার!' বলে সম্বোধন করে। অনেকে উল্লেখ করেছে 'ইস্কান্দর! ইস্কান্দর!' বলে সম্বোধন করে।
ইতিহাস বিশ্লেষণ করে অলিভার স্টোনের তৈরি মুভিতে দেখানো হয়েছে যে তাকে 'সিকান্দার! সিকান্দার!' বলে সম্বোধন করে। মুসলিম ইতিহাসবিদদের অনেকেই জুলকারনাইনকে বাদশাহ সিকান্দার হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
জুলকারনাইন সমন্ধে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া দরকার। আসুন তার সমন্ধে কিছু জেনে নেই।
আল্লাহ তা'আলা বলেছেন-
"তারা আপনাকে যুলকারনাইন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলুনঃ আমি তোমাদের কাছে তাঁর কিছু অবস্থা বর্ণনা করব।
আমি তাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম এবং প্রত্যেক বিষয়ের কার্যোপকরণ দান করেছিলাম।
অতঃপর তিনি এক কার্যোপকরণ অবলম্বন করলেন।
অবশেষে তিনি যখন সুর্যের অস্তাচলে পৌছলেন; তখন তিনি সুর্যকে এক পঙ্কিল জলাশয়ে অস্ত যেতে দেখলেন এবং তিনি সেখানে এক সম্প্রদায়কে দেখতে পেলেন। আমি বললাম, হে যুলকারনাইন! আপনি তাদেরকে শাস্তি দিতে পারেন অথবা তাদেরকে সদয়ভাবে গ্রহণ করতে পারেন।"
[সুরা কাহফঃ ৮৩-৮৬]
জুলকারনইন পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়াতেন নির্যাতীত, বঞ্চিত, শাসকের হাতে শোসিত লোকদের মুক্তি দিতেন। ইয়াজুজ, মাজুজের হাত থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য দেয়াল তুলে দিয়েছিলেন জুলকারণাইন। আর সে স্থানটি পাহাড়ের প্রাচীরের মাঝখানে।
ধারণা করা হয় এই জাতি ধাতুর ব্যবহার জানতো। তারা হাপর বা ফুঁক নল দ্বারা বায়ু প্রবাহ চালনা করে ধাতুকে উত্তপ্ত করে গলাতে পারতো এবং তারা লোহার পিন্ড ও গলিত সীসাও তৈরি করতে পারতো।
পরবর্তী আয়াতের বিভিন্ন বাংলা অনুবাদে গলিত তামার উল্লেখ আছে। ইংরেজি অনুবাদে তামার স্থলে সীসার উল্লেখ আছে। জুলকারনাইন তাদের প্রতিরোধ প্রাচীর তৈরি করার জন্য উপাদান ও শ্রম সরবরাহ করতে বললেন। তারা নিজেরাই জুলকারনাইনের আদেশ মত দুই পর্বতের মাঝে শক্ত লোহার প্রাচীর বা দ্বার তৈরি করলো।
ইয়াজুজ মাজুজ জাতি কে বাইবেলে 'গগ ম্যাগগ' হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। ইয়াজুজ মাজুজ নিয়ে লেখার অনেক ইচ্ছা আছে। তবে তা অন্য কোনো একদিন লিখব।
আলেকজান্ডারের টপিকে আবার ফিরে আসা যাক। তখন একটি ক্ষমতাধর রাজ্য ছিল মিশর। তিনি মিশর জয় করেন গৌরবের সাথে এবং তাঁর নামানুসারে নগরীর নাম রাখলেন আলেকজান্দ্রিয়া।
আলেকজান্ডার শুধু অভিযানে পটু ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন বই প্রেমিকও। বই পড়া ছিল তাঁর অন্যতম সখ। গ্রিক মনীষী এরিস্টোটল ছিলেন সম্রাট আলেকজান্ডারের গৃহ শিক্ষক। এই আদর্শবান খ্যাতিমান শিক্ষকের কাছে তিনি পেয়েছিলেন জীবনে সংগ্রামী হওয়ার অনুপ্রেরণা এবং বই পাঠের অদম্য বাসনা।
প্রিয় শিক্ষকের উৎসাহে আলেকজান্ডার ধীরে ধীরে গ্রন্থ পাঠে মনোযোগী হয়ে উঠেন। বই তাঁকে যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করত। বই থেকে তিনি জীবনের পথ চলার দিক নির্দেশনা পেতে চাইতেন সবসময়। তাঁর প্রিয় বই ছিল মহাকবি হোমার রচিত ইলিয়াড। বইটি তিনি বহুবার একাগ্রচিত্তে পাঠ করেছিলেন। মহাকাব্যটি পড়ে তিনি আয়ত্ত করেন অমিত সাহসের কথা, বীরত্বের কথা, দৃপ্তপথে এগিয়ে যাওয়ার কথা।
এরিস্টটলের কথা যেহেতু চলে আসছে সেহেতু একটা ইনফরমেশন জেনে রাখা ভাল। আর তা হলো-
এরিস্টটল ছিলেন আলেকজান্ডারের শিক্ষক,
এরিস্টটলের শিক্ষক ছিলেন প্লেটো,
প্লেটোর শিক্ষক ছিলেন সক্রেটিস।
শিক্ষক ও ছাত্র ক্রমানুসারে সাজিয়ে দেখা যাক,
সক্রেটিস→প্লেটো →এরিস্টটল→আলেকজান্ডার
আলেকজান্ডারকে নিয়ে অনেক কবি ও লেখক কবিতা এবং লেখা লিখে গেছেন। পারস্যের অমর কবি শাহানামা’র রচয়িতা মহাকবি ফেরদৌসী বিশ্ব-নন্দিত বীর পুরুষ আলোকজান্ডারের বীরত্বগাথা রচনা করে ধন্য হয়েছেন।
তাঁর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মতৎপরতার আলোকে সফল অভিযানের মাধ্যমে মহামতি সম্রাট বলে আখ্যায়িত হয়েছিলেন আলেকজান্ডার। তিনি এশিয়া মাইনর, সিরিয়া, মিশর, মধ্য এশিয়া, ভারত বর্ষের বিস্তৃত অঞ্চল অধিকার করেছিলেন।
এশিয়া মাইনরের কথা চলে আসায় পৃথিবীতে প্রথম যেখানে চুম্বকের সন্ধান মেলে তা হলো এশিয়া মাইনর। এশিয়া মাইনরের বর্তমান নাম হলো আনাতোলিয়া। তবে প্রাচীন কালে এশিয়া মাইনর বলতে যে অঞ্চল বুঝানো হতো তা শুধু আনাতোলিয়া না, তুরষ্কের অধিকাংশ অঞ্চল ছিল এশিয়া মাইনরের অন্তর্ভুক্ত। তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারা আনাতোলিয়াতেই অবস্থিত।
ট্রয় নগরীর নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই! বর্তমানে ট্রয় একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের নাম। হোমারের ইলিয়াডে যে ট্রয়ের উল্লেখ রয়েছে সেটিকেই এখন ট্রয় নামে আখ্যায়িত করা হয়। এর অবস্থান আনাতোলিয়া অঞ্চলের হিসারলিক নামক স্থানে। ট্রয়ের তুর্কী নাম ত্রুভা। গ্রীকপুরাণ অনুযায়ী দীর্ঘ দশ বছর ব্যাপী রক্তক্ষয়ী ট্রয় যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এই যুদ্ধের আরেক নাম হলো ট্রোজান যুদ্ধ।
কেনো এই ট্রয় যুদ্ধ শুরু হয়েছিল? আসুন জেনে নেই বিস্তারিত।
প্রাচীন যুগের বিশ্ব সুন্দরী হেলেনের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই! মজার ব্যাপার হলো হেলেন কিন্তু পুরুষবাচক শব্দ। তবে যাইহোক, ইতিহাসের হেলেন একজন মহিলা ছিলেন।
তিন হাজার বছরেরও আগের কথা। মাত্র একজন নারীকে উদ্ধার করতে এজিয়ান সাগর পাড়ি দিল এক হাজার জাহাজ। তখনও দুনিয়ার সেরা সুন্দরী হিসেবে তাকেই মনে করা হতো। যদিও এই সৌন্দর্যের কারনেই সুখী হতে পারেননি তিনি । তার জন্য ট্রয়ের যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিল হাজার হাজার যোদ্ধা। ধুলোয় মিশে গেলো সুখী ও সমৃ্দ্ধিশালী একটি জনপদ -ট্রয়। সেই তিনি হচ্ছেন হেলেন।
এশিয়া মাইনর অর্থাৎ আনাতোলিয়া যেন তেন জায়গা না, এটা শুধু আধুনিক যুগে বিখ্যাত না, এটা মধ্য যুগে যেমন বিখ্যাত ছিল তেমনি বিখ্যাত ছিল প্রাচীন যুগেও। পাথুরে যুগে তারা এই অঞ্চলে সভ্যতা গড়ে তুলে। এই অঞ্চলে তিনটি কৃষিভিত্তিক শহরের নাম পাওয়া যায়। তা হলো-
১. নেভালি কোরি (Nevalı Çori): খ্রিষ্টপূর্ব ৮৪০০ থেকে ৮১০০ অব্দ পর্যন্ত এই নগরীর অস্তিত্ব ছিল।
২. ক্যাটালহোয়য়িক (Çatalhöyük): খ্রিষ্টপূর্ব ৭৫০০ থেকে ৫৭০০ অব্দ পর্যন্ত এই নগরীর অস্তিত্ব ছিল।
৩. ক্যায়ওনু (Çayönü): খ্রিষ্টপূর্ব ৭২০০ থেকে ৬৬০০ অব্দ পর্যন্ত এই নগরীর অস্তিত্ব ছিল।
প্রাচীন কালে এশিয়া মাইনরকে হস্তগত করার জন্য বিভিন্ন শক্তি চেষ্টা চালালেও খ্রিষ্টপূর্ব ৪৪৯ অব্দে স্বাধীনতা লাভ করে। পরিবর্তীতে আলেকজান্ডার দখল করতে সক্ষম হয়। তবে তা বেশিদিন টিকে ছিল না।
এরপর এই অঞ্চলে বিভিন্ন শাসনের চড়াই উৎরাই হতে থাকে। গ্রীকদের পর হেলেনিকরা, হেলেনিকদের পর রোমানরা, রোমানদের পর আর্মেনিয়ানরা এরপর আবারও রোমানরা শাসন করে। তবে সর্বশেষ মুসলমানদের অধীনে আসলে এশিয়া মাইনরকে তুরষ্কের অধীনে করে ফেলে যা আজও একই অবস্থায় রয়েছে।
এখানে অনেক গুলি জাতির বসবাস রয়েছে। তারা হলো- তুর্কি, কুর্দি, আলবেনিয়ান, এরাবিয়ান, আর্মেনিয়ান, এসেরিয়ান, আজারবাইজানী, বসনিয়াক, বুলগেরিয়ান, চেচেনিয়ান, ককেশিয়ান, ক্রিমিয়ান,তাতার, গ্রীক, লাজি ইত্যাদি।
তবে এদের মধ্যে তুর্কি এবং কুর্দি হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ।
এশিয়া মাইনর বা আনাতোলিয়া হলো এমন জায়গা যেখানে প্রাচীনকাল, মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগে অনেক গুলি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। তার মধ্যে ট্রয় যুদ্ধ এবং ক্রুসেড অন্যতম।
যেহেতু লেখা শুরু করেছিলোম মহামতি আলেকজান্ডারকে নিয়ে তাই তার দিকে ফিরে আসা যাক। ৩২৩ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে আরব জয়ের উদ্দ্যেশে বের হন। পৌছান ব্যবিলন, এখানে ১৯ মে এক ভোজসভায় অংশ নেন। খাওয়ার পর পেটে শুরু হয় ভয়ানক ব্যাথা।
৩২৩ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে মৃত্যু হয়, তার মৃত্যু নিয়ে আজও আছে মতভেদ। কেউ বলেন খাদ্যে বিষ ক্রিয়া, কেউ বলেন, ম্যালেরিয়া আবার কেউ বলেন অন্ত্রের কোন ক্ষতই তার মৃত্যুর কারন।
বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান লেখকের উপন্যাস পড়ার সময় পেয়েছিলাম যে, 'আলেকজান্ডার গঙ্গারিদ্ধি অঞ্চলের গঙ্গা নদীর ইলিশ খুব পছন্দ করেছিলেন। আর এই সুস্বাদু ইলিশ খেতে গিয়ে একবার তার গলায় ইলিশ মাছের কাটা বিঁধে যায়। এরপর তিনি অসুস্থ হয়ে গেলে ভারত বর্ষ ত্যাগ করেন এবং সেই অসুস্থতা থেকেই তিনি মারা যান।'
যাইহোক, মৃত্যুর পূর্বলগ্নে বিষণ্ণ আলেকজান্ডার তাঁর সেনাপতিদের ডাকলেন এবং তিনি সবাইকে সমবেত করে বললেন, ‘আমি ওপারের ডাক শুনতে পাচ্ছি, বুঝতে পারছি খুব তাড়াতাড়ি পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেবো। আমার অন্তিম তিনটি ইচ্ছে আছে, সেগুলো যেন অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়।’
সেনাপতিরা অশ্রুসজল চোখে আলেকজান্ডারের কথায় সম্মতি জানালেন। আলেকজান্ডার বলা শুরু করলেন,
‘আমার প্রথম ইচ্ছে- আমার মৃতদেহ সমাধিক্ষেত্রে বহন করে নিয়ে যাবে কেবল আমার চিকিৎসকেরা।’
একটু থেমে তিনি টেনে টেনে শ্বাস নিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আবার বললেন,
‘আমার দ্বিতীয় ইচ্ছে- সমাধি পানে আমার মৃতদেহ বয়ে নিয়ে যাবে যে পথে-সেই পথে আমার অর্জিত সব সোনা-রূপা, মণি-মুক্তা, ধনরত্ন ছড়িয়ে দেওয়া হবে।’
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার তিনি বললেন, ‘আমার তৃতীয় এবং শেষ ইচ্ছে হলো- মৃতদেহ বহনের সময় আমার হাত দুটো কফিনের ভেতর থেকে বাইরে বের করে রাখবে।’
আলেকজান্ডারের প্রিয় সেনাপতি তাঁর হাতে গভীর শ্রদ্ধামাখা চুম্বন করে বললেন, ‘আমরা অবশ্যই আপনার এসব ইচ্ছে পূরণ করব। কিন্তু মহান সম্রাট! আমাদের বড় কৌতূহল জাগছে, আপনি অনুগ্রহ করে বলবেন, কেন এমন আদেশ?’
আলেকজান্ডারের চোখের কোণে অশ্রু চিকচিক করে উঠলো, কিন্তু ঠোঁটের কোণে খেলছে রহস্যময় হাসি। তিনি বললেন, 'আমি আমার জীবনের বিনিময়ে তিনটি বিষয় শিখেছি, তা পৃথিবীর কাছে পৌঁছে দিতে চাই। প্রথমত, আমার মৃতদেহ চিকিৎসকেরা বহন করবে, যেন সবাই উপলব্ধি করতে পারে- মানুষের জীবন প্রদীপ ফুরিয়ে এলে পৃথিবীর কোন চিকিৎসকের পক্ষে সম্ভব নয় তাকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনা।'
দ্বিতীয় ইচ্ছের ব্যাখ্যায় আলেকজান্ডার বলেন, ‘সমাধিপানের পথে ধনরত্ন ছড়িয়ে দেবে, যেন সবাই জেনে যায়- আমি সারা জীবন ব্যয় করেছি সম্পদ অর্জনের পেছনে, কিন্তু তার কিছুই সাথে করে নিতে পারছি না।'
'তৃতীয়ত, কফিনের বাইরে হাত বের করে রাখবে। কারণ আমি বিশ্বকে জানাতে চাই- আমি পৃথিবীতে শূন্য হাতে এসেছিলাম, আবার যাওয়ার সময় শূন্য হাতেই ফিরে যাচ্ছি।'
লিখতে গেলে অনেক কথাই লেখা যায়। কিন্তু পড়ার ধৈর্য সবার না থাকতেও পারে। যদি আলেকজান্ডার এবং এশিয়া মাইনর সমন্ধে আরো জানতে চান তাহলে গুগলে সার্চ দিন অথবা এই বিষয়ের উপর রচিত বই গুলি পড়তে পারেন।
মহামতি আলেকজান্ডারের একটি উক্তি দিয়েই লেখা শেষ করতে চাই-
"আমি ভেড়ার নেতৃত্বে সিংহ বাহিনীকে ভয় পাই না,
কিন্তু সিংহের নেতৃত্বে ভেড়ার পালকে ভয় পাই।"
Comments
Post a Comment