বিভিন্ন ধর্মে ডিভোর্স, তালাক কিংবা বিবাহবিচ্ছেদ - তৌহিদ রাসেল
বিভিন্ন ধর্মে ডিভোর্স, তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদ!- তৌহিদ রাসেল
বাঙালি মেয়েরা স্বামীকে এতই ভালবাসে যে স্বামীকে কেটে গাঙ্গে ভাসিয়ে দিবে তবুও স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে দিবেনা। অথচ বাংলাদেশের পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে ডিভোর্সের দিক দিয়ে ৭৫% ডিভোর্স দিচ্ছেন মেয়েরা। অর্থাৎ অধিকাংশ ডিভোর্স আসে মেয়েদের পক্ষ থেকে।
স্বামীকে যদি মেয়েরা এতই ভালবাসে তাহলে মেয়ে পক্ষ থেকে কেন আগে ডিভোর্সের প্রস্তাব আসে! প্রশ্ন রয়েই যায়।
জেনে নেওয়া যাক ডিভোর্সের এপিঠ-ওপিঠ।
ডিভোর্স ইংরেজি শব্দ। বাংলায় বলে বিবাহবিচ্ছেদ আর ইসলামী পরিভাষায় বলে তালাক। তালাক শব্দের অর্থ 'বিচ্ছিন্ন', ত্যাগ করা ইত্যাদি। এছাড়াও তালাক অর্থ বিবাহের বাঁধন তুলিয়া ও খুলিয়া দেওয়া, বা বিবাহের শক্ত বাঁধন খুলিয়া দেওয়া, স্বামী তার স্ত্রীর সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে দেওয়া।
ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়ার উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ উল্লেখ করা হলো-
মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনঃ এক্ষেত্রে কমবেশি উভয়ই ভুক্তভোগী হয়ে থাকে। ছেলেরা মেয়েদের দ্বারা শারীরিকভাবে নির্যাতিত না হলেও আজকাল নারীদের দ্বারা অনেক পুরুষরাই মানসিকভাবে নির্যাতিত হয়ে থাকে। অপরদিকে নারীরা পুরুষদের দ্বারা সবসময়ই মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়ে থাকেন। অনেক সময় এই নির্যাতনের শিকার হয়েই অবশেষে ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তারা।
অন্তরঙ্গতার অভাবঃ ঘনিষ্ঠতা যৌনতার চেয়ে অনেক বেশি দামী। সঙ্গীর প্রতি মনোযোগ দেওয়া ঘনিষ্ঠতার অন্তর্ভুক্ত। বিয়ের পর ধীরে ধীরে অন্তরঙ্গতার অভাব দেখা দিতে থাকে। ফলে সম্পর্ক গিয়ে ডিভোর্সে রূপ নেয়।
পরকীয়াঃ বর্তমান সময়ের ডিভোর্সের অনেক বড় কারণ হলো এই পরকীয়া। এই সমস্যা নারী-পুরুষ দুজনের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়। বিবাহের পূর্বে থাকা সম্পর্ক, নিজেদের মধ্যে বনিবনা না হওয়া, পছন্দ-অপছন্দের তারতম্য থাকাসহ আরো নানা কারণে নারী-পুরুষরা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক অর্থাৎ পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে এটাই ডিভোর্সের অন্যতম কারণ হয়ে দাড়ায়।
যোগাযোগের অভাবঃ বিবাহের ক্ষেত্রে যোগাযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং দ্রুত কার্যকরভাবে যোগাযোগ করতে না পারা উভয়ের জন্য বিরক্তি এবং হতাশার দিকে পরিচালিত করে, যা বিবাহের সমস্ত দিককে প্রভাবিত করে। 65% ডিভোর্সের সবচেয়ে বড় কারণ হল দুর্বল যোগাযোগ।
আত্ননির্ভরশীলতাঃ আজকাল আর কোনো নারীকে কোনো পুরুষের উপর নির্ভর করে চলতে হয় না। এখনকার নারীরা বেশ আত্ননির্ভর। কোনো কারণে স্বামীর সাথে বনিবনা না হলে খুব সহজেই ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায় তারা।
অর্থের অভাবঃ বর্তমান সময়ে টিকে থাকতে হলে অর্থের গুরুত্ব অনেক। ‘কথায় আছে, টাকা না থাকলে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়।’ কথাটি অযৌক্তিক নয়। বর্তমানে অনেক ডিভোর্সই হয়ে থাকে স্বামীর অস্বচ্ছলতায় সংসারে অভাব-অনটন ও অশান্তির কারণে।
নিজেদের মধ্যে ভুলবোঝাবুঝিঃ ৪৪ শতাংশ ডিভোর্স হয় নিজেদের জেদ আর ভুল বোঝাবুঝিতে। কেউ যখন মুখোমুখি পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতে না চান বা নিজের জেদ ধরে বসে থাকেন তখন সেই সমস্যা সমাধান হওয়ার নয়। দুজনেই দুজনের ভুল ধরতে ব্যস্ত। শোধরাতে নয়। ফলাফল গিয়ে দাঁড়ায় ডিভোর্সে।
পরিস্থিতি এবং পারিপার্শ্বিক কারণঃ অনেক সময় স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে তেমন কোনো সমস্যা থাকে না। কিন্ত দেখা যায় যে শ্বশুরবাড়ির লোকেদের সাথে ঠিকমতো মানিয়ে নিতে পারে না পুত্রবধূ বা শাশুড়ি ছেলের ব্যক্তিগত জীবনে খুব বেশি নাক গলাচ্ছেন। বা শ্বাশুড়ি বউমার সাথে ছেলের সামনে এক রকম এবং ছেলের পেছনে আরেক রকম ব্যবহার করেন। এদিকে ছেলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে আলাদা সংসার করাও সম্ভব নয়। আলোচনা করেও যখন সমস্যার সমাধান হয় না, তখন বহু ক্ষেত্রেই স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
যৌতুকঃ যৌতুক আমাদের দেশের সামাজিক ব্যাধিগুলোর মধ্যে আরেকটি। এই প্রবণতা শিক্ষিত আর অশিক্ষিত বা গ্রাম/শহর নয়, পুরো দেশ জুড়েই রয়েছে প্রকোপ। যৌতুক আদায়ের মাধ্যম হিসেবে স্বামীর পরিবার হতে লাঞ্চিত, নির্যাতিত হয়ে ধৈর্য হারিয়ে অবশেষে ডির্ভোর্সের পথ বেছে নেন অনেকেই।
সোশ্যাল মিডিয়াঃ আমরা আজকাল কমবেশি সবাই এই ব্যাপারটার সাথে জড়িত। অনেকেই আসক্ত হয়ে পড়ছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। পরিবারের দিকে মনযোগ হারিয়ে ফেলছেন। কেউ ডুবে যাচ্ছেন রঙিন দুনিয়ায়, ভুলে যাচ্ছেন বাস্তবতা। কেউ কাউকে সময় দিচ্ছে না। এসব নানা কারণে ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়ছে।
এখন বিভিন্ন ধর্মের আলোকে তালাক বা ডিভোর্স নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস মতে, বিবাহ-বিচ্ছেদ সম্ভব নয়। একবার বিয়ে হয়ে গেলে আর ডিভোর্স বা তালাক সম্ভব না। তবে, অপ্রিয় হলেও এটাই সত্যি যে হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ না থাকার ফলে একজন হিন্দু স্ত্রী মনে মনে তার স্বামীর মৃত্যু কামনা করা ছাড়া আর বৈধ কিছুই করতে পারবে না। কেননা, বাংলাদেশে একজন হিন্দু স্ত্রী তার স্বামীর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বামীর দ্বারা শারীরিক, মানসিক যত প্রকারের নির্যাতনই হোক না কেন, বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারবেন না। কিন্তু, স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী যখন বিধবা হবে, তখন বিধবা বিবাহ আইনের অধীনে হিন্দু বিধবা নারী পুনরায় বিবাহ করতে পারবেন। যদিও শুনতে বিষয়টিতে নিষ্ঠুরতা প্রকাশ পায়, কিন্তু এটাই কঠিন বাস্তবতা।
এতো হতাশার মাঝেও একটি আশার আলো হচ্ছে, হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ না থাকলেও নির্দিষ্ট কিছু শর্তে স্বামীর কাছ থেকে আলাদা থাকার সুযোগ রয়েছে। খুব সংক্ষেপে শর্ত গুলো আলোচনা করার চেষ্টা করবো যেগুলোর ভিত্তিতে এক হিন্দু স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে আলাদা থাকতে পারবে, শর্তগুলো নিম্নরূপ:
১। স্বামী যদি খুব নিষ্ঠুর প্রকৃতির হয় এবং যার ফলে তার সাথে থাকাটা অনিরাপদ। এই কারণটাই সবচেয়ে বেশি আমাদের সমাজে।
স্বামী পুনরায় বিয়ে করলে। নারী সবকিছু শেয়ার বা ভাগাভাগি করতে পারলেও স্বামীকে কখনোই অন্য স্ত্রীলোকের সাথে শেয়ার করতে পারবে না। যার ফলে সেপারেশন অনিবার্য। স্বামী পুনরায় বিয়ে না করে যদি উপপত্নী রাখে, সেক্ষেত্রেও স্ত্রী সেপারেশন করতে পারবে।
২। স্বামী এমন কোন রোগে আক্রান্ত যার ফলে স্ত্রী আর স্বামীর সাথে থাকা সম্ভব নয়, তখন স্ত্রী সেপারেশনের জন্য আবেদন করতে পারবেন। বিষয়টি একটু অমানবিক বলে মনে হলেও ধরুন আপনার মেয়ে বা বোনের স্বামী এইডস রোগে আক্রান্ত, আপনি কি আপনার বোন বা মেয়েকে আর ঐ সংসারে পাঠাবেন, যেখানে কিনা আপনার মেয়ে বা বোনেরও এইডস হওয়ার সর্বোচ্চ সুযোগ রয়েছে?
৩। স্বামী যদি হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করে।
তাছাড়া বিবিধ অন্য কোন যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে যদি স্ত্রীলোকটি আদালতকে সন্তুষ্ট করতে পারে যে, তার সেপারেশন দরকার, আর আদালত সন্তুষ্ট হলে তবেই কেবল আদালত সেপারেশনের জন্য অনুমতি দিতে পারেন। এখানে উল্লেখ্য, সেপারেশনে থাকাবস্থায় স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে বাধ্য স্বামী।
খ্রিস্টান ধর্মে ‘তালাক’ উচ্চারণ করলেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায় না। নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে ‘আমি বিবাহ বিচ্ছেদ করলাম’ অথবা ‘আজ থেকে আমরা আর স্বামী-স্ত্রী নই’ এ ধরনের কথা লিখে নোটারি করলেও বিবাহ বিচ্ছেদ হবে না। এমনকী যদি কোনো খ্রিস্টান দম্পতি নিজেরা সমঝোতার মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ নেবার জন্য কোনো চুক্তি করেন তবে সেটি কোর্ট থেকে ডিক্রি না নেওয়া পর্যন্ত কার্যকর হবে না।
আইন অনুযায়ী নির্ধারিত এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদের মোকদ্দমা করে শুনানি পূর্বক রায় নিয়ে তবেই খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত দম্পতিরা বিবাহ বিচ্ছেদ করতে পারেন। ডিভোর্স অ্যাক্ট, ১৮৬৯-এ বলা আছে যে কোথায়, কিভাবে এবং কী কী কারণে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত দম্পতিরা বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আদালতে মোকদ্দমা করতে পারবেন।
ডিভোর্স অ্যাক্ট, ১৮৬৯-এর ১০ ধারা মতে স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য মোকদ্দমা দায়ের করতে পারেন। এই ধারায় আরো উল্লেখ করা আছে যে কী কী কারণে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত একজন স্ত্রী তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে বিবাহ বিচ্ছেদের মোকদ্দমা করতে পারেন। ১০ ধারা মতে স্বামী বা স্ত্রী জেলা জজ বা হাইকোর্ট বিভাগে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য মোকদ্দমা দায়ের করতে পারেন।
জেলা জজ বিবাহ বিচ্ছেদের পক্ষে রায় দিলে ঐ রায়টি কার্যকর হবার জন্য হাইকোর্টের কনফারমেশন লাগবে। হাইকোর্ট বিভাগের তিনজন বিচারপতির বেঞ্চে এই শুনানি হবে, যদি ভিন্ন মতামত হয় তবে মেজোরিটির রায় প্রাধান্য পাবে। আবার যদি দুজন বিচারপতির বেঞ্চে শুনানি হয় এবং ভিন্ন রায় আসে তবে সিনিয়র বিচারপতির মতামত প্রাধান্য পাবে। ধারা ১১ মতে যদি কোনো স্বামী তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে অ্যাডেল্ট্রি বা ব্যভিচারের অভিযোগ এনে বিবাহ বিচ্ছেদ চান তবে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে ঐ লোকের নামও পিটিশনে লিখতে হবে।
বৌদ্ধ ধর্মে বিবাহের কোন ধর্মীয় ধারণা নেই। বৌদ্ধ ধর্মে, বিবাহ একটি ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়, স্থানীয় রীতিনীতি সাপেক্ষে। সেজন্য বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের বিবাহবন্ধন, বিবাহবিচ্ছেদ আইন তৈরি করা হয়েছে। যেসব কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ সম্ভব সেসব তুলে ধরা হলো।
১। স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন যদি সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয়।
২। বিবাহের পর স্বামী বা স্ত্রী কেউ যদি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে অন্য কারো সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে থাকে।
৩। স্বামী বা স্ত্রী যদি অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করে।
৪। স্বামী বা স্ত্রী অনারোগ্য মানসিক বিকারগ্রস্ত হোন।
৫। যদি স্বামী কর্তৃক স্ত্রী অথবা স্ত্রী কর্তৃক স্বামী নিষ্ঠুর দৈহিক বা মানসিক আচরণের শিকার হয়।
৬। স্বামী যদি সংসারজীবন ত্যাগ করিয়া বৌদ্ধ ভিক্ষু বা ভিক্ষুণী সংঘের অন্তর্ভুক্ত হয়।
৭। স্বামী বা স্ত্রী যদি সাত বছর অথবা তার অধিককাল নিখোঁজ থাকে কিংবা আদালত কর্তৃক যদি সাত বছর বা তার অধিককাল সাজাপ্রাপ্ত হয়।
ইসলাম ধর্মে তালাক হলো একটি হালাল বিষয়। তবে বলা হয়েছে যে তালাক হলো নিকৃষ্টতম হালাল। কুরআনে 'তালাক' নামের পুরো একটি সূরা নাযিল করা হয়েছে। তালাক শব্দের আভিধানিক অর্থ বন্ধনমুক্ত করা। শরীয়তের পরিভাষায় স্ত্রীকে বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত করা।
তালাক দেয়ার অধিকার পুরুষের অর্থাৎ স্বামীর। আর স্ত্রীর অধিকার খুলা করার। খুলার আভিধানিক অর্থ খসিয়ে নেওয়া, টেনে বের করে ফেলা। আর শরীয়তের পরিভাষায় স্বামীকে কিছু মাল দিয়ে নিজকে স্বামীর বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত করে নেয়া। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : ‘তবে তাদের উপর কোনো গুনাহ হবে না যদি স্ত্রী স্বামীকে মাল দিয়ে নিজকে ছাড়িয়ে নেয়’। (সূরা বাকারা : ২২৯)
তাছাড়া ইসলামিক পারিবারিক আইন অনুযায়ী স্বামীর অর্পিত ক্ষমতাবলেও স্ত্রীর তালাক দেয়ার ক্ষমতা আছে।
খুলা প্রদানে ইমামদের মতভেদ আছে। ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মালিক (রহ.)-এর মতে খুলা মূলত তালাক। পক্ষান্তরে ইমাম আহম্মদ ও শাফিঈ (রহ.)-র বর্ণনামতে খুলা তালাক নয়; বরং এটা বিবাহকে ফিসক করে তথা বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটায়।
অন্যান্য ধর্মে বিবাহবিচ্ছেদ একটি সহজ প্রক্রিয়া হলেও ইসলামে তালাক একটি জটিল এবং নিয়মমাফিক বিষয়। এর মূল কারণ হলো তালাকে অনুৎসাহিত করা।
তালাকের অনেকগুলো প্রকারভেদ রয়েছে। পদ্ধতিগত দিক দিয়ে তালাক তিন প্রকারঃ- (ক) আহসান বা সর্বোত্তম তালাক ; (খ) হাসান বা উত্তম তালাক এবং (গ) বিদ'ই বা শরিয়া বিরূদ্ধ তালাক।
ক্ষমতা বা এখতিয়ার গত দিক দিয়ে তালাক পাঁচ প্রকারঃ- (১) তালাকে সুন্নাত (২) তালাকে বাদী (৩) তালাকে তাফবীজ (৪) তালাকে মোবারত ও (৫) খোলা তালাক।
কার্যকর হওয়ার দিক দিয়ে তালাক প্রধানত দুই প্রকারঃ- (১) তালাকে রেজী ও (২) তালাকে বাইন
তালাকে বাইন আবার দুই প্রকারঃ- (১)বাইনে সগির ও (২) বাইনে কবির।
মর্যাদা ও অবস্থানের দিক থেকে তালাক চার প্রকারঃ- (১) হারাম (২) মাকরুহ (৩) মুস্তাহাব ও (৪) ওয়াজিব
ইসলামে তালাকের অধিকার সীমিত করা হয়েছে তিনবারের মধ্যে। প্রথম দু’বার ‘রাজ‘ঈ’ ও শেষেরটি ‘বায়েন’। অর্থাৎ ইসলামে তালাকের বিধান রাখা হ’লেও স্বামীকে ভাববার ও সমঝোতার সুযোগ দেওয়া হয় স্ত্রীর তিন ঋতু বা তিন মাসকাল যাবত। এর মধ্যে স্বামী তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারেন। যাকে ‘রাজ‘আত’ বলা হয়। কিন্তু গভীর ভাবনা-চিন্তার পর ঠান্ডা মাথায় তৃতীয়বার তালাক দিলে তখন আর ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে না।
(১) স্ত্রীকে তার ঋতুমুক্তির পর পবিত্র অবস্থার শুরুতে মিলন ছাড়াই স্বামী প্রথমে এক তালাক দিবে। অতঃপর সহবাসহীন অবস্থায় তিন ঋতুর ইদ্দত অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বে স্বামী স্ত্রীকে রাজ‘আত করতে পারে। অর্থাৎ ফিরিয়ে নিতে পারে। কিন্তু ইদ্দতকাল শেষ হওয়ার পরে ফেরত নিতে চাইলে তাকে উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে নতুন বিবাহের মাধ্যমে ফেরত নিতে হবে। ইদ্দতকালে স্ত্রী স্বামীগৃহে অবস্থান করবে। অবস্থানকালে স্বামী স্ত্রীকে খোরপোষ দিবে। এটিই হ’ল তালাকের সর্বোত্তম পন্থা।
(২) সহবাসহীন তোহরে প্রথম তালাক দিয়ে ইদ্দতের মধ্যে পরবর্তী তোহরে ২য় তালাক দিবে এবং ইদ্দতকাল গণনা করবে। অতঃপর পরবর্তী তোহরের শুরুতে তৃতীয় তালাক দিবে ও ঋতু আসা পর্যন্ত সর্বশেষ ইদ্দত পালন করবে। তৃতীয়বার তালাক উচ্চারণ করলে স্ত্রীকে আর ফেরৎ নেওয়া যাবে না। অতএব ২য় তোহরে ২য় তালাক দিলে ৩য় তোহরের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এখানেও পূর্বের ন্যায় যাবতীয় বিধান বহাল থাকবে (বাক্বারাহ ২/২২৯; তালাক ৬৫/১)।
ইসলামের সোনালী যুগে এই তালাকই চালু ছিল।
যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূল (সা:) কে সম্বোধন করে বলেন, ‘হে নবী! যদি আপনি স্ত্রীদের তালাক দিতে চান, তাহলে ইদ্দত অনুযায়ী তালাক দিন এবং ইদ্দত গণনা করতে থাকুন। আপনি আপনার প্রভু সম্বন্ধে হুঁশিয়ার থাকুন। সাবধান তালাকের পর স্ত্রীদেরকে গৃহ হতে বিতাড়িত করবেন না, আর তারাও যেন স্বামীগৃহ ছেড়ে বহির্গত না হয়। অবশ্য তারা যদি খোলাখুলিভাবে ফাহেশা কাজে লিপ্ত হয়, তাহলে স্বতন্ত্র কথা। এগুলি আল্লাহকৃত সীমারেখা। যে ব্যক্তি উক্ত সীমারেখা লংঘন করে, সে নিজের উপরে যুলুম করে। কেননা সে জানে না যে, তালাকের পরেও আল্লাহ কোন সমঝোতার পথ বের করে দিতে পারেন’ (তালাক্ব ৬৫/১)।
জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! কুরআনে দু’বার তালাক দেবার কথা পাচ্ছি। কিন্তু তৃতীয় তালাক কোথায়? রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, ‘অথবা সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে বিদায় করুক’। অর্থাৎ আল্লাহ চান না যে, বান্দা স্বীয় স্ত্রীকে তৃতীয় তালাক দিক। কেননা তৃতীয় তালাক দিলে সে আর তার স্ত্রীকে ফেরত পাবে না। যতক্ষণ না সে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করে এবং সেই স্বামী তাকে স্বেচ্ছায় তালাক দেয়।
কুরতুবী (রহ:) বলেন, বিদ্বানগণ এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, ‘অথবা সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে বিদায় করুক’ দ্বারা দুই তালাকের পরে তৃতীয় তালাক বুঝানো হয়েছে। আর এটা বুঝা গেছে পরবর্তী বক্তব্য ‘অতঃপর যদি সে তাকে তালাক দেয়’ আয়াতাংশ দ্বারা। অতঃপর বিদ্বানগণ এবিষয়ে একমত হয়েছেন যে, যে ব্যক্তি তার স্ত্রীকে এক তালাক অথবা দুই তালাক দিবে, সে ব্যক্তি তাকে ফিরিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু যদি তৃতীয়বার তালাক দেয়, তাহ’লে ঐ স্ত্রী তার জন্য আর হালাল হবে না, যতক্ষণ না সে অন্য স্বামীকে বিবাহ করবে’। আর এটিই কুরআনের স্পষ্ট বক্তব্য। যাতে কারু কোনরূপ মতভেদ নেই।
আল্লাহ এতই মেহেরবান যে, সর্বশেষ তৃতীয়বার তালাকের কারণে উক্ত স্বামী ও স্ত্রীকে চিরকালের মত পরস্পরের জন্য নিষিদ্ধ করেননি। বরং যদি কখনও দ্বিতীয় স্বামী তাকে স্বেচ্ছায় তালাক দেয়, তখন সে পুনরায় তার পূর্বতন স্বামীর কাছে ফিরে আসতে পারে, যদি উভয়ে স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে রাজি হয়। এতেই বুঝা যায় যে, বিবাহের পবিত্র বন্ধনকে আল্লাহ পাক কত বেশী গুরুত্ব প্রদান করেছেন এবং একে টিকিয়ে রাখার জন্য কত ভাবেই না বান্দাকে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
বৈবাহিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে মনোবিজ্ঞানীরা কিছু সাধারণ পরামর্শ দিয়েছে, যা দাম্পত্যজীবন সুখী এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলে।
মনের মিলঃ দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মনের মিল। মনের মিল না থাকলে সংসার জীবনে সুখী হওয়া যায় না। আর সবসময় মনের মিল না-ও হতে পারে। তাই বলে অন্য কারও তুলনা টেনে আনবেন না। এতে হীনম্মন্যতায় ভুগতে পারেন সঙ্গী।
জোর করবেন নাঃ আপনার স্ত্রীকে শারীরিক ঘনিষ্ঠতায় জোর করবেন না বা কোনও কিছু চাপিয়ে দেবেন না। অনেকেই মুখ ফুটে নিজের চাহিদার কথা বলতে পারেন না। ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলুন। বুঝে নিন ঠিক কী চান তিনি।
সঙ্গীর পছন্দকেও গুরুত্ব দিনঃ স্বামী বা স্ত্রী দুজন দুজনের পছন্দের গুরুত্ব দিন। ভালোবাসা যেন শরীরসর্বস্ব না হয়। বরং মন জয় করুন।
বিশেষ দিনে উপহারঃ বিশেষ দিন যেমন, বিবাহবার্ষিকী, জন্মদিন। এই দিন গুলোতে বিশেষ আয়োজন রাখতে পারেন। এছাড়া উভয়ে নিজেদের উপাহার দিতে পারেন। এত সংসার হবে আনন্দময়।
ভুল বুঝাবুঝি মিটিয়ে ফেলাঃ সংসার জীবনে ভুল বুঝাবুঝি, ঝগড়া হতে পারে। নিজেদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা করুন। আর মনের মধ্যে কষ্ট চেপে রাখবেন না। এতে সঙ্গীর প্রতি বিশ্বাস কমে যায়।
হঠাৎ পরিবর্তনঃ জোর করে কিছু পাল্টে ফেলার চেষ্টা করবেন না। আরোপিত কোনও কিছুই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এতে করে সংসারের শান্তি নষ্ট হয়। তাই সবকিছুর মধ্যে সংযত ভাব আনুন।
সপ্তাহে একদিন ঘুরতে যাওয়াঃ দাম্পত্য জীবনে সুখে থাকার অন্য আরেকটি উপায় হচ্ছে ঘুরে বেড়ানো। কারণ সারা সপ্তাহ কাজ করে মন ও শরীর ঠিক রাখতে এবং রোমাঞ্চ করেত সঙ্গীর সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে পারেন।
ধর্মীয় জীবনযাপনঃ প্রতিটি ধর্মই দাম্পত্যজীবনের গুরুত্ব দিয়েছে এবং রয়েছে বিধিনিষেধ। তাই ধর্মীয় জীবন অনুসরণ করলে সংসারে অশান্তি দূর হবে।
আর দাম্পত্য জীবন সুখী করার মূল টেকনিক একটি গবেষণায় উঠে এসেছে। সেখানে দেখা গিয়েছে যে প্রতিটি স্ত্রী তার স্বামীর কাছে থেকে চায় ভালবাসা ও সময় আর স্বামী স্ত্রীর কাছে থেকে চায় সম্মান ও শ্রদ্ধা। অর্থাৎ স্ত্রী চায় ভালবাসা এবং স্বামী চায় শ্রদ্ধা। এই দুটো জিনিস যদি ঠিক ভাবে বজায় রাখা যায় তাহলেই দাম্পত্য জীবন হয়ে উঠে সুখী ও স্বাচ্ছন্দ্যময়।
বাঙালি মেয়েরা স্বামীকে এতই ভালবাসে যে স্বামীকে কেটে গাঙ্গে ভাসিয়ে দিবে তবুও স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে দিবেনা। অথচ বাংলাদেশের পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে ডিভোর্সের দিক দিয়ে ৭৫% ডিভোর্স দিচ্ছেন মেয়েরা। অর্থাৎ অধিকাংশ ডিভোর্স আসে মেয়েদের পক্ষ থেকে।
স্বামীকে যদি মেয়েরা এতই ভালবাসে তাহলে মেয়ে পক্ষ থেকে কেন আগে ডিভোর্সের প্রস্তাব আসে! প্রশ্ন রয়েই যায়।
জেনে নেওয়া যাক ডিভোর্সের এপিঠ-ওপিঠ।
ডিভোর্স ইংরেজি শব্দ। বাংলায় বলে বিবাহবিচ্ছেদ আর ইসলামী পরিভাষায় বলে তালাক। তালাক শব্দের অর্থ 'বিচ্ছিন্ন', ত্যাগ করা ইত্যাদি। এছাড়াও তালাক অর্থ বিবাহের বাঁধন তুলিয়া ও খুলিয়া দেওয়া, বা বিবাহের শক্ত বাঁধন খুলিয়া দেওয়া, স্বামী তার স্ত্রীর সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে দেওয়া।
ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়ার উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ উল্লেখ করা হলো-
মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনঃ এক্ষেত্রে কমবেশি উভয়ই ভুক্তভোগী হয়ে থাকে। ছেলেরা মেয়েদের দ্বারা শারীরিকভাবে নির্যাতিত না হলেও আজকাল নারীদের দ্বারা অনেক পুরুষরাই মানসিকভাবে নির্যাতিত হয়ে থাকে। অপরদিকে নারীরা পুরুষদের দ্বারা সবসময়ই মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়ে থাকেন। অনেক সময় এই নির্যাতনের শিকার হয়েই অবশেষে ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তারা।
অন্তরঙ্গতার অভাবঃ ঘনিষ্ঠতা যৌনতার চেয়ে অনেক বেশি দামী। সঙ্গীর প্রতি মনোযোগ দেওয়া ঘনিষ্ঠতার অন্তর্ভুক্ত। বিয়ের পর ধীরে ধীরে অন্তরঙ্গতার অভাব দেখা দিতে থাকে। ফলে সম্পর্ক গিয়ে ডিভোর্সে রূপ নেয়।
পরকীয়াঃ বর্তমান সময়ের ডিভোর্সের অনেক বড় কারণ হলো এই পরকীয়া। এই সমস্যা নারী-পুরুষ দুজনের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়। বিবাহের পূর্বে থাকা সম্পর্ক, নিজেদের মধ্যে বনিবনা না হওয়া, পছন্দ-অপছন্দের তারতম্য থাকাসহ আরো নানা কারণে নারী-পুরুষরা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক অর্থাৎ পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে এটাই ডিভোর্সের অন্যতম কারণ হয়ে দাড়ায়।
যোগাযোগের অভাবঃ বিবাহের ক্ষেত্রে যোগাযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং দ্রুত কার্যকরভাবে যোগাযোগ করতে না পারা উভয়ের জন্য বিরক্তি এবং হতাশার দিকে পরিচালিত করে, যা বিবাহের সমস্ত দিককে প্রভাবিত করে। 65% ডিভোর্সের সবচেয়ে বড় কারণ হল দুর্বল যোগাযোগ।
আত্ননির্ভরশীলতাঃ আজকাল আর কোনো নারীকে কোনো পুরুষের উপর নির্ভর করে চলতে হয় না। এখনকার নারীরা বেশ আত্ননির্ভর। কোনো কারণে স্বামীর সাথে বনিবনা না হলে খুব সহজেই ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায় তারা।
অর্থের অভাবঃ বর্তমান সময়ে টিকে থাকতে হলে অর্থের গুরুত্ব অনেক। ‘কথায় আছে, টাকা না থাকলে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়।’ কথাটি অযৌক্তিক নয়। বর্তমানে অনেক ডিভোর্সই হয়ে থাকে স্বামীর অস্বচ্ছলতায় সংসারে অভাব-অনটন ও অশান্তির কারণে।
নিজেদের মধ্যে ভুলবোঝাবুঝিঃ ৪৪ শতাংশ ডিভোর্স হয় নিজেদের জেদ আর ভুল বোঝাবুঝিতে। কেউ যখন মুখোমুখি পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতে না চান বা নিজের জেদ ধরে বসে থাকেন তখন সেই সমস্যা সমাধান হওয়ার নয়। দুজনেই দুজনের ভুল ধরতে ব্যস্ত। শোধরাতে নয়। ফলাফল গিয়ে দাঁড়ায় ডিভোর্সে।
পরিস্থিতি এবং পারিপার্শ্বিক কারণঃ অনেক সময় স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে তেমন কোনো সমস্যা থাকে না। কিন্ত দেখা যায় যে শ্বশুরবাড়ির লোকেদের সাথে ঠিকমতো মানিয়ে নিতে পারে না পুত্রবধূ বা শাশুড়ি ছেলের ব্যক্তিগত জীবনে খুব বেশি নাক গলাচ্ছেন। বা শ্বাশুড়ি বউমার সাথে ছেলের সামনে এক রকম এবং ছেলের পেছনে আরেক রকম ব্যবহার করেন। এদিকে ছেলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে আলাদা সংসার করাও সম্ভব নয়। আলোচনা করেও যখন সমস্যার সমাধান হয় না, তখন বহু ক্ষেত্রেই স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
যৌতুকঃ যৌতুক আমাদের দেশের সামাজিক ব্যাধিগুলোর মধ্যে আরেকটি। এই প্রবণতা শিক্ষিত আর অশিক্ষিত বা গ্রাম/শহর নয়, পুরো দেশ জুড়েই রয়েছে প্রকোপ। যৌতুক আদায়ের মাধ্যম হিসেবে স্বামীর পরিবার হতে লাঞ্চিত, নির্যাতিত হয়ে ধৈর্য হারিয়ে অবশেষে ডির্ভোর্সের পথ বেছে নেন অনেকেই।
সোশ্যাল মিডিয়াঃ আমরা আজকাল কমবেশি সবাই এই ব্যাপারটার সাথে জড়িত। অনেকেই আসক্ত হয়ে পড়ছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। পরিবারের দিকে মনযোগ হারিয়ে ফেলছেন। কেউ ডুবে যাচ্ছেন রঙিন দুনিয়ায়, ভুলে যাচ্ছেন বাস্তবতা। কেউ কাউকে সময় দিচ্ছে না। এসব নানা কারণে ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়ছে।
এখন বিভিন্ন ধর্মের আলোকে তালাক বা ডিভোর্স নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস মতে, বিবাহ-বিচ্ছেদ সম্ভব নয়। একবার বিয়ে হয়ে গেলে আর ডিভোর্স বা তালাক সম্ভব না। তবে, অপ্রিয় হলেও এটাই সত্যি যে হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ না থাকার ফলে একজন হিন্দু স্ত্রী মনে মনে তার স্বামীর মৃত্যু কামনা করা ছাড়া আর বৈধ কিছুই করতে পারবে না। কেননা, বাংলাদেশে একজন হিন্দু স্ত্রী তার স্বামীর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বামীর দ্বারা শারীরিক, মানসিক যত প্রকারের নির্যাতনই হোক না কেন, বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারবেন না। কিন্তু, স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী যখন বিধবা হবে, তখন বিধবা বিবাহ আইনের অধীনে হিন্দু বিধবা নারী পুনরায় বিবাহ করতে পারবেন। যদিও শুনতে বিষয়টিতে নিষ্ঠুরতা প্রকাশ পায়, কিন্তু এটাই কঠিন বাস্তবতা।
এতো হতাশার মাঝেও একটি আশার আলো হচ্ছে, হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ না থাকলেও নির্দিষ্ট কিছু শর্তে স্বামীর কাছ থেকে আলাদা থাকার সুযোগ রয়েছে। খুব সংক্ষেপে শর্ত গুলো আলোচনা করার চেষ্টা করবো যেগুলোর ভিত্তিতে এক হিন্দু স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে আলাদা থাকতে পারবে, শর্তগুলো নিম্নরূপ:
১। স্বামী যদি খুব নিষ্ঠুর প্রকৃতির হয় এবং যার ফলে তার সাথে থাকাটা অনিরাপদ। এই কারণটাই সবচেয়ে বেশি আমাদের সমাজে।
স্বামী পুনরায় বিয়ে করলে। নারী সবকিছু শেয়ার বা ভাগাভাগি করতে পারলেও স্বামীকে কখনোই অন্য স্ত্রীলোকের সাথে শেয়ার করতে পারবে না। যার ফলে সেপারেশন অনিবার্য। স্বামী পুনরায় বিয়ে না করে যদি উপপত্নী রাখে, সেক্ষেত্রেও স্ত্রী সেপারেশন করতে পারবে।
২। স্বামী এমন কোন রোগে আক্রান্ত যার ফলে স্ত্রী আর স্বামীর সাথে থাকা সম্ভব নয়, তখন স্ত্রী সেপারেশনের জন্য আবেদন করতে পারবেন। বিষয়টি একটু অমানবিক বলে মনে হলেও ধরুন আপনার মেয়ে বা বোনের স্বামী এইডস রোগে আক্রান্ত, আপনি কি আপনার বোন বা মেয়েকে আর ঐ সংসারে পাঠাবেন, যেখানে কিনা আপনার মেয়ে বা বোনেরও এইডস হওয়ার সর্বোচ্চ সুযোগ রয়েছে?
৩। স্বামী যদি হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করে।
তাছাড়া বিবিধ অন্য কোন যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে যদি স্ত্রীলোকটি আদালতকে সন্তুষ্ট করতে পারে যে, তার সেপারেশন দরকার, আর আদালত সন্তুষ্ট হলে তবেই কেবল আদালত সেপারেশনের জন্য অনুমতি দিতে পারেন। এখানে উল্লেখ্য, সেপারেশনে থাকাবস্থায় স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে বাধ্য স্বামী।
খ্রিস্টান ধর্মে ‘তালাক’ উচ্চারণ করলেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায় না। নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে ‘আমি বিবাহ বিচ্ছেদ করলাম’ অথবা ‘আজ থেকে আমরা আর স্বামী-স্ত্রী নই’ এ ধরনের কথা লিখে নোটারি করলেও বিবাহ বিচ্ছেদ হবে না। এমনকী যদি কোনো খ্রিস্টান দম্পতি নিজেরা সমঝোতার মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ নেবার জন্য কোনো চুক্তি করেন তবে সেটি কোর্ট থেকে ডিক্রি না নেওয়া পর্যন্ত কার্যকর হবে না।
আইন অনুযায়ী নির্ধারিত এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদের মোকদ্দমা করে শুনানি পূর্বক রায় নিয়ে তবেই খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত দম্পতিরা বিবাহ বিচ্ছেদ করতে পারেন। ডিভোর্স অ্যাক্ট, ১৮৬৯-এ বলা আছে যে কোথায়, কিভাবে এবং কী কী কারণে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত দম্পতিরা বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আদালতে মোকদ্দমা করতে পারবেন।
ডিভোর্স অ্যাক্ট, ১৮৬৯-এর ১০ ধারা মতে স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য মোকদ্দমা দায়ের করতে পারেন। এই ধারায় আরো উল্লেখ করা আছে যে কী কী কারণে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত একজন স্ত্রী তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে বিবাহ বিচ্ছেদের মোকদ্দমা করতে পারেন। ১০ ধারা মতে স্বামী বা স্ত্রী জেলা জজ বা হাইকোর্ট বিভাগে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য মোকদ্দমা দায়ের করতে পারেন।
জেলা জজ বিবাহ বিচ্ছেদের পক্ষে রায় দিলে ঐ রায়টি কার্যকর হবার জন্য হাইকোর্টের কনফারমেশন লাগবে। হাইকোর্ট বিভাগের তিনজন বিচারপতির বেঞ্চে এই শুনানি হবে, যদি ভিন্ন মতামত হয় তবে মেজোরিটির রায় প্রাধান্য পাবে। আবার যদি দুজন বিচারপতির বেঞ্চে শুনানি হয় এবং ভিন্ন রায় আসে তবে সিনিয়র বিচারপতির মতামত প্রাধান্য পাবে। ধারা ১১ মতে যদি কোনো স্বামী তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে অ্যাডেল্ট্রি বা ব্যভিচারের অভিযোগ এনে বিবাহ বিচ্ছেদ চান তবে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে ঐ লোকের নামও পিটিশনে লিখতে হবে।
বৌদ্ধ ধর্মে বিবাহের কোন ধর্মীয় ধারণা নেই। বৌদ্ধ ধর্মে, বিবাহ একটি ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়, স্থানীয় রীতিনীতি সাপেক্ষে। সেজন্য বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের বিবাহবন্ধন, বিবাহবিচ্ছেদ আইন তৈরি করা হয়েছে। যেসব কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ সম্ভব সেসব তুলে ধরা হলো।
১। স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন যদি সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয়।
২। বিবাহের পর স্বামী বা স্ত্রী কেউ যদি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে অন্য কারো সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে থাকে।
৩। স্বামী বা স্ত্রী যদি অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করে।
৪। স্বামী বা স্ত্রী অনারোগ্য মানসিক বিকারগ্রস্ত হোন।
৫। যদি স্বামী কর্তৃক স্ত্রী অথবা স্ত্রী কর্তৃক স্বামী নিষ্ঠুর দৈহিক বা মানসিক আচরণের শিকার হয়।
৬। স্বামী যদি সংসারজীবন ত্যাগ করিয়া বৌদ্ধ ভিক্ষু বা ভিক্ষুণী সংঘের অন্তর্ভুক্ত হয়।
৭। স্বামী বা স্ত্রী যদি সাত বছর অথবা তার অধিককাল নিখোঁজ থাকে কিংবা আদালত কর্তৃক যদি সাত বছর বা তার অধিককাল সাজাপ্রাপ্ত হয়।
ইসলাম ধর্মে তালাক হলো একটি হালাল বিষয়। তবে বলা হয়েছে যে তালাক হলো নিকৃষ্টতম হালাল। কুরআনে 'তালাক' নামের পুরো একটি সূরা নাযিল করা হয়েছে। তালাক শব্দের আভিধানিক অর্থ বন্ধনমুক্ত করা। শরীয়তের পরিভাষায় স্ত্রীকে বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত করা।
তালাক দেয়ার অধিকার পুরুষের অর্থাৎ স্বামীর। আর স্ত্রীর অধিকার খুলা করার। খুলার আভিধানিক অর্থ খসিয়ে নেওয়া, টেনে বের করে ফেলা। আর শরীয়তের পরিভাষায় স্বামীকে কিছু মাল দিয়ে নিজকে স্বামীর বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত করে নেয়া। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : ‘তবে তাদের উপর কোনো গুনাহ হবে না যদি স্ত্রী স্বামীকে মাল দিয়ে নিজকে ছাড়িয়ে নেয়’। (সূরা বাকারা : ২২৯)
তাছাড়া ইসলামিক পারিবারিক আইন অনুযায়ী স্বামীর অর্পিত ক্ষমতাবলেও স্ত্রীর তালাক দেয়ার ক্ষমতা আছে।
খুলা প্রদানে ইমামদের মতভেদ আছে। ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মালিক (রহ.)-এর মতে খুলা মূলত তালাক। পক্ষান্তরে ইমাম আহম্মদ ও শাফিঈ (রহ.)-র বর্ণনামতে খুলা তালাক নয়; বরং এটা বিবাহকে ফিসক করে তথা বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটায়।
অন্যান্য ধর্মে বিবাহবিচ্ছেদ একটি সহজ প্রক্রিয়া হলেও ইসলামে তালাক একটি জটিল এবং নিয়মমাফিক বিষয়। এর মূল কারণ হলো তালাকে অনুৎসাহিত করা।
তালাকের অনেকগুলো প্রকারভেদ রয়েছে। পদ্ধতিগত দিক দিয়ে তালাক তিন প্রকারঃ- (ক) আহসান বা সর্বোত্তম তালাক ; (খ) হাসান বা উত্তম তালাক এবং (গ) বিদ'ই বা শরিয়া বিরূদ্ধ তালাক।
ক্ষমতা বা এখতিয়ার গত দিক দিয়ে তালাক পাঁচ প্রকারঃ- (১) তালাকে সুন্নাত (২) তালাকে বাদী (৩) তালাকে তাফবীজ (৪) তালাকে মোবারত ও (৫) খোলা তালাক।
কার্যকর হওয়ার দিক দিয়ে তালাক প্রধানত দুই প্রকারঃ- (১) তালাকে রেজী ও (২) তালাকে বাইন
তালাকে বাইন আবার দুই প্রকারঃ- (১)বাইনে সগির ও (২) বাইনে কবির।
মর্যাদা ও অবস্থানের দিক থেকে তালাক চার প্রকারঃ- (১) হারাম (২) মাকরুহ (৩) মুস্তাহাব ও (৪) ওয়াজিব
ইসলামে তালাকের অধিকার সীমিত করা হয়েছে তিনবারের মধ্যে। প্রথম দু’বার ‘রাজ‘ঈ’ ও শেষেরটি ‘বায়েন’। অর্থাৎ ইসলামে তালাকের বিধান রাখা হ’লেও স্বামীকে ভাববার ও সমঝোতার সুযোগ দেওয়া হয় স্ত্রীর তিন ঋতু বা তিন মাসকাল যাবত। এর মধ্যে স্বামী তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারেন। যাকে ‘রাজ‘আত’ বলা হয়। কিন্তু গভীর ভাবনা-চিন্তার পর ঠান্ডা মাথায় তৃতীয়বার তালাক দিলে তখন আর ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে না।
(১) স্ত্রীকে তার ঋতুমুক্তির পর পবিত্র অবস্থার শুরুতে মিলন ছাড়াই স্বামী প্রথমে এক তালাক দিবে। অতঃপর সহবাসহীন অবস্থায় তিন ঋতুর ইদ্দত অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বে স্বামী স্ত্রীকে রাজ‘আত করতে পারে। অর্থাৎ ফিরিয়ে নিতে পারে। কিন্তু ইদ্দতকাল শেষ হওয়ার পরে ফেরত নিতে চাইলে তাকে উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে নতুন বিবাহের মাধ্যমে ফেরত নিতে হবে। ইদ্দতকালে স্ত্রী স্বামীগৃহে অবস্থান করবে। অবস্থানকালে স্বামী স্ত্রীকে খোরপোষ দিবে। এটিই হ’ল তালাকের সর্বোত্তম পন্থা।
(২) সহবাসহীন তোহরে প্রথম তালাক দিয়ে ইদ্দতের মধ্যে পরবর্তী তোহরে ২য় তালাক দিবে এবং ইদ্দতকাল গণনা করবে। অতঃপর পরবর্তী তোহরের শুরুতে তৃতীয় তালাক দিবে ও ঋতু আসা পর্যন্ত সর্বশেষ ইদ্দত পালন করবে। তৃতীয়বার তালাক উচ্চারণ করলে স্ত্রীকে আর ফেরৎ নেওয়া যাবে না। অতএব ২য় তোহরে ২য় তালাক দিলে ৩য় তোহরের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এখানেও পূর্বের ন্যায় যাবতীয় বিধান বহাল থাকবে (বাক্বারাহ ২/২২৯; তালাক ৬৫/১)।
ইসলামের সোনালী যুগে এই তালাকই চালু ছিল।
যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূল (সা:) কে সম্বোধন করে বলেন, ‘হে নবী! যদি আপনি স্ত্রীদের তালাক দিতে চান, তাহলে ইদ্দত অনুযায়ী তালাক দিন এবং ইদ্দত গণনা করতে থাকুন। আপনি আপনার প্রভু সম্বন্ধে হুঁশিয়ার থাকুন। সাবধান তালাকের পর স্ত্রীদেরকে গৃহ হতে বিতাড়িত করবেন না, আর তারাও যেন স্বামীগৃহ ছেড়ে বহির্গত না হয়। অবশ্য তারা যদি খোলাখুলিভাবে ফাহেশা কাজে লিপ্ত হয়, তাহলে স্বতন্ত্র কথা। এগুলি আল্লাহকৃত সীমারেখা। যে ব্যক্তি উক্ত সীমারেখা লংঘন করে, সে নিজের উপরে যুলুম করে। কেননা সে জানে না যে, তালাকের পরেও আল্লাহ কোন সমঝোতার পথ বের করে দিতে পারেন’ (তালাক্ব ৬৫/১)।
জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! কুরআনে দু’বার তালাক দেবার কথা পাচ্ছি। কিন্তু তৃতীয় তালাক কোথায়? রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, ‘অথবা সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে বিদায় করুক’। অর্থাৎ আল্লাহ চান না যে, বান্দা স্বীয় স্ত্রীকে তৃতীয় তালাক দিক। কেননা তৃতীয় তালাক দিলে সে আর তার স্ত্রীকে ফেরত পাবে না। যতক্ষণ না সে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করে এবং সেই স্বামী তাকে স্বেচ্ছায় তালাক দেয়।
কুরতুবী (রহ:) বলেন, বিদ্বানগণ এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, ‘অথবা সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে বিদায় করুক’ দ্বারা দুই তালাকের পরে তৃতীয় তালাক বুঝানো হয়েছে। আর এটা বুঝা গেছে পরবর্তী বক্তব্য ‘অতঃপর যদি সে তাকে তালাক দেয়’ আয়াতাংশ দ্বারা। অতঃপর বিদ্বানগণ এবিষয়ে একমত হয়েছেন যে, যে ব্যক্তি তার স্ত্রীকে এক তালাক অথবা দুই তালাক দিবে, সে ব্যক্তি তাকে ফিরিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু যদি তৃতীয়বার তালাক দেয়, তাহ’লে ঐ স্ত্রী তার জন্য আর হালাল হবে না, যতক্ষণ না সে অন্য স্বামীকে বিবাহ করবে’। আর এটিই কুরআনের স্পষ্ট বক্তব্য। যাতে কারু কোনরূপ মতভেদ নেই।
আল্লাহ এতই মেহেরবান যে, সর্বশেষ তৃতীয়বার তালাকের কারণে উক্ত স্বামী ও স্ত্রীকে চিরকালের মত পরস্পরের জন্য নিষিদ্ধ করেননি। বরং যদি কখনও দ্বিতীয় স্বামী তাকে স্বেচ্ছায় তালাক দেয়, তখন সে পুনরায় তার পূর্বতন স্বামীর কাছে ফিরে আসতে পারে, যদি উভয়ে স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে রাজি হয়। এতেই বুঝা যায় যে, বিবাহের পবিত্র বন্ধনকে আল্লাহ পাক কত বেশী গুরুত্ব প্রদান করেছেন এবং একে টিকিয়ে রাখার জন্য কত ভাবেই না বান্দাকে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
বৈবাহিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে মনোবিজ্ঞানীরা কিছু সাধারণ পরামর্শ দিয়েছে, যা দাম্পত্যজীবন সুখী এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলে।
মনের মিলঃ দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মনের মিল। মনের মিল না থাকলে সংসার জীবনে সুখী হওয়া যায় না। আর সবসময় মনের মিল না-ও হতে পারে। তাই বলে অন্য কারও তুলনা টেনে আনবেন না। এতে হীনম্মন্যতায় ভুগতে পারেন সঙ্গী।
জোর করবেন নাঃ আপনার স্ত্রীকে শারীরিক ঘনিষ্ঠতায় জোর করবেন না বা কোনও কিছু চাপিয়ে দেবেন না। অনেকেই মুখ ফুটে নিজের চাহিদার কথা বলতে পারেন না। ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলুন। বুঝে নিন ঠিক কী চান তিনি।
সঙ্গীর পছন্দকেও গুরুত্ব দিনঃ স্বামী বা স্ত্রী দুজন দুজনের পছন্দের গুরুত্ব দিন। ভালোবাসা যেন শরীরসর্বস্ব না হয়। বরং মন জয় করুন।
বিশেষ দিনে উপহারঃ বিশেষ দিন যেমন, বিবাহবার্ষিকী, জন্মদিন। এই দিন গুলোতে বিশেষ আয়োজন রাখতে পারেন। এছাড়া উভয়ে নিজেদের উপাহার দিতে পারেন। এত সংসার হবে আনন্দময়।
ভুল বুঝাবুঝি মিটিয়ে ফেলাঃ সংসার জীবনে ভুল বুঝাবুঝি, ঝগড়া হতে পারে। নিজেদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা করুন। আর মনের মধ্যে কষ্ট চেপে রাখবেন না। এতে সঙ্গীর প্রতি বিশ্বাস কমে যায়।
হঠাৎ পরিবর্তনঃ জোর করে কিছু পাল্টে ফেলার চেষ্টা করবেন না। আরোপিত কোনও কিছুই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এতে করে সংসারের শান্তি নষ্ট হয়। তাই সবকিছুর মধ্যে সংযত ভাব আনুন।
সপ্তাহে একদিন ঘুরতে যাওয়াঃ দাম্পত্য জীবনে সুখে থাকার অন্য আরেকটি উপায় হচ্ছে ঘুরে বেড়ানো। কারণ সারা সপ্তাহ কাজ করে মন ও শরীর ঠিক রাখতে এবং রোমাঞ্চ করেত সঙ্গীর সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে পারেন।
ধর্মীয় জীবনযাপনঃ প্রতিটি ধর্মই দাম্পত্যজীবনের গুরুত্ব দিয়েছে এবং রয়েছে বিধিনিষেধ। তাই ধর্মীয় জীবন অনুসরণ করলে সংসারে অশান্তি দূর হবে।
আর দাম্পত্য জীবন সুখী করার মূল টেকনিক একটি গবেষণায় উঠে এসেছে। সেখানে দেখা গিয়েছে যে প্রতিটি স্ত্রী তার স্বামীর কাছে থেকে চায় ভালবাসা ও সময় আর স্বামী স্ত্রীর কাছে থেকে চায় সম্মান ও শ্রদ্ধা। অর্থাৎ স্ত্রী চায় ভালবাসা এবং স্বামী চায় শ্রদ্ধা। এই দুটো জিনিস যদি ঠিক ভাবে বজায় রাখা যায় তাহলেই দাম্পত্য জীবন হয়ে উঠে সুখী ও স্বাচ্ছন্দ্যময়।
Comments
Post a Comment