র্যাগ ডে - Rag Day
র্যাগ ডে
- তৌহিদ রাসেল
অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে ৩১৫ নাম্বারে বসে নাজিফা ম্যামের ক্লাস করতেছিলাম। হঠাৎ দূর থেকে ব্যান্ড পার্টির ঢোল আর বাঁশির ভেসে আসা শব্দ নিকটবর্তী হতে থাকলো। কিছুক্ষণ পর দেখলাম ব্যান্ড পার্টির শব্দে ম্যাম ক্লাসে কি পড়াচ্ছেন কিছুই শুনতে পারতেছিনা।
আমি ভাবলাম হয়তো ভার্সিটিতে কোনো মন্দির আছে অথবা কোনো হিন্দু ফ্যামিলির বিয়ে। কারণ আমি এলাকাতে দেখতাম পূজার সময় নয়তো হিন্দুদের বিয়ের সময় ব্যান্ড পার্টি ভাড়া করে আনা হতো। আরেকটা কারণেও ব্যান্ড পার্টি আনা হতো সেটা হলো কোনো মাজারের বা ফকিরের মেলার ওরস উপলক্ষে।
কিন্তু ভার্সিটির সেদিনের সেই ব্যান্ড পার্টি কোনো পূজা, বিয়ে কিংবা কোনো ওরসের ছিল না। এগুলো করা হচ্ছিলো ভার্সিটির কোনো এক ডিপার্টমেন্টের একটি ব্যাচ বিদায় উপলক্ষে। পরে জানতে পারলাম এই প্রোগ্রামকে বলা হয় 'র্যাগ ডে'। অথচ আমি এতদিন জেনে এসেছি 'র্যাগ' মানে ভার্সিটির সিনিয়র কর্তৃক জুনিয়রদের নানানভাবে হেনস্তা করা।
যাইহোক জারুলতলার পাশে দাঁড়িয়ে 'র্যাগ ডে' পালনকারীদের কর্মকান্ড। সাউন্ড সিস্টেম বাজিয়ে সবাই মিলে নাচতেছে। ছেলেমেয়ে একসাথে হৈ-হুল্লোড় করে। মাঝে মাঝে একজন আরেকজনকে রঙ মেখে দিচ্ছিলো গালে অথবা শরীরের বিভিন্ন জায়গায়। ছেলে-মেয়ে কোনো ভেদাভেদ নেই। ছেলে মেয়ের গালে রঙ মাখাচ্ছে, মেয়ে ছেলের গালে অথবা শরীরে। কেউ কেউ মার্কার দিয়ে সাদা টি-শার্টে নানান কথা লিখে দিচ্ছে। কি সব লিখতেছে দূর থেকে বুঝা যাচ্ছিলো না।
এরপরের বছর আমাদের ডিপার্টমেন্টের সিনিয়রদের র্যাগ ডে হলো। আমি জানতাম না। ক্লাস করতে এসে জেনেছি। পরে আমাদের সবাইকে সেই র্যাগ ডে তে জয়েন করতে হয়। কারণ, সিনিয়র কয়েকজন বড় ভাইয়ের সাথে ভাল সম্পর্ক থাকায় তাদের হুকুম আমরা অমান্য করতে পারিনি। সেদিন আসলে পুরোপুরিভাবে জানতে পেরেছি আসলে র্যাগ ডে জিনিসটা কি!
সেদিন খুব কাছে থেকেই দেখেছি একজন আরেকজনের গালে কি বিশ্রীভাবে রঙ মাখিয়ে দিচ্ছে। এছাড়াও টি-শার্টের উপরে কিসব বিশ্রী কথা লিখা! যদিও কিছু কিছু লেখা খুবই আবেগপূর্ণ তবে অনেকেই মজার ছলে খুব বাজে শব্দ ইউজ করে লিখেছিল। আচ্ছা বিদায় এত নোংরা কেন!
'র্যাগ ডে' এর রঙ মাখামাখি দেখে হিন্দুদের একটি ধর্মীয় উৎসব 'হোলি উৎসব'' এর কথা মনে পড়ে গেলো। যে উৎসবে ভেদাভেদহীনভাবে সবাই সবাইকে রঙ মাখিয়ে দেয়। আচ্ছা র্যাগ ডে জিনিসটা কিভাবে বাংলাদেশে আসলো অথবা কিভাবে এবং কেনো এত জনপ্রিয় হয়ে উঠলো! একটা এডভার্টাইজে বলা হতো বাঁচতে হলে জানতে হবে। আসলেই আমাদের জানতে হবে।
'RAG' শব্দের পূর্ণরূপ হলো Raise and Give, Raising and Giving অথবা Raise and Grand। এগুলো ছিলো ইউরোপের ভার্সিটিগুলোতে স্নাতক শেষে স্টুডেন্টরা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতো। আর RAG সেই কর্মসূচিরই একটি অংশ। মূলত ভিক্টোরিয়ান যুগে বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্র দুস্থদের জন্য র্যাগ বা পুরনো কাপড় সংগ্রহ করতে শুরু করে। পড়ালেখার পাশাপাশি এই দাতব্য কাজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করে।
অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে ১৮৬৪ সালের পূর্বে ‘র্যাগ’ শব্দটি ছিল না। র্যাগ গ্রিক সংস্কৃতি থেকে এসেছে। সপ্তম-অষ্টম শতকে খেলার মাঠে খেলোয়াড়দের মনোবল বৃদ্ধির জন্য র্যাগিং নামক এক ধরনের উৎসবের প্রচলন শুরু হয়। ইউরোপে এর প্রচলন ঘটে অষ্টম শতকের মাঝামাঝি। ইউরোপ-আমেরিকায় এর যাত্রা হলেও বর্তমানে ভারতীয় উপমহাদেশে এর ব্যবহার সর্বাধিক।
বর্তমান বিশ্বে 'র্যাগ ডে' এর অর্থ পুরোই বদলে গেছে। বর্তমান ডিকশনারিতে 'র্যাগ' অর্থ হলো জ্বালাতন করা, রসিকতার নামে কারো উপর অত্যাচার করা, অত্যাধিক হৈহুল্লোরের মাধ্যমে আনন্দ প্রকাশ করা, ন্যকড়া, ত্যানা বা টুকরা কাপড়, পুরোনো ছেড়া কাপড়, অগোছালো পোশাক পরিহিত ব্যক্তি ইত্যাদি।
র্যাগ ডে মানে হলে জ্বালাতন বা অত্যাচারের দিন। যারা পাশাত্য অপসংস্কৃতির আগ্রাসনে ত্যাক্ত বিরক্ত, আনন্দের নামে কান্ডজ্ঞানহীন বাড়াবাড়ি যাদের অপছন্দ, ঢোল বাদ্য বাজনা, বেশরম ছেলেমেয়েতে রঙ নিয়ে মাখামাখি, ছেলেমেয়ের একি পোশাকে নাচানাচি যাদের অসস্তির কারণ তাদের জন্য দিনটি জ্বালাময়, অত্যাচারিত হওয়ার দিন।
এই দিনে অনেক রক্ষণশীল ভাই বোনের লজ্জা, রুচিশীলতা, পর্দানশীলতা রসিকতার ধোকায় অত্যারিত, স্বকীয়তার পতন, ভালমানুষির পরাজয় হয়। ভুলে যায় একদিন কেন, এক মুহুর্তের জন্যও জেনে বুঝে সীমালঙ্গন অমার্জনীয়। বাদ্য-বাজনা, হিন্দী-ইংলিশ গানের গগণবিদারী আওয়াজে ক্যাম্পাস রঙ্গমঞ্চে পরিণত। ছাত্রদের স্যারের লেকচারে মনোযোগ আসে না। পরীক্ষার হলে স্বাভাবিক পরিবেশ বিঘ্নিত।
তাহলে এটা জ্বালাতন অথবা অত্যাচার দিবস নয়? আশেপাশের দোকানদার বা অন্যান্য মানুষদের নিকট এটি কতটুকু জ্বালাময় সে কথা না হয় বাদই দিলাম।
আজকাল র্যাগ ডে তে যা হয় তা অনাচার আর অসুস্থ বিনোদন ছাড়া আর কিছু নয়। এইদিনে সবাই বেশামাল হয়ে পড়ে। র্যাগ ডে আর হিন্দুদের হোলি উৎসবের মাঝে তফাৎ থাকেনা। রঙ চং মেখে এক একটা যেন গোবরের স্তুপ থেকে উঠে আসা সাক্ষাত ভূত প্রেত। র্যাগ অর্থ যদি হয় অগোছালো পোশাক পরিধান তবে র্যাগ ডে মানে হল অগোছালো পোশাক পরিধানের দিন, কে কত অগছালো পোশাক পরতে পারে তা নিয়ে প্রতিযোগিতায় চলে।
আজকাল স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে যে 'র্যাগ ডে' নামক দিবস পালন করা হয় এতে অংশগ্রহণ করার শরয়ী হুকুম কি?
‘র্যাগ ডে’ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা বা আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা সম্পূর্ণরূপে হারাম। কেননা, এটি গ্রীক কালচার থেকে আগত একটি অসভ্য প্রথা। আর রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদের দলভুক্ত গণ্য হবে। (আবু দাউদ ৪০৩১)
ইবনুল কাইয়িম রহ. বলেন, 'যারা বাস্তবেই আলেম তাঁরা সকলেই এব্যাপারে একমত যে, মুসলিমদের জন্য মুশরিকদের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা মোটেই জায়েয নেই। এবিষয়ে চার মাযহাবের ফকিহগণই তাঁদের কিতাবাদিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন।' (আহকামুযযিম্মাহ ১/৭২৩)
নাচ-গান, ছেলে-মেয়ের এক সঙ্গে আনন্দ-উল্লাস হয় এই দিনের প্রধান উপকরণ। আর নাচ-গান নিঃসন্দেহে হারাম। রাসুল (সাঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, 'আমার উম্মতের মধ্য হতে একদল লোক এমন হবে যারা ব্যভিচার, রেশমি বস্ত্র পরিধান, মদ পান এবং বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার ইত্যাদি হালাল মনে করবে।' [বুখারী, ভলিউম ৭, বুক ৬৯, সংখ্যা ৪৯৪]
আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'এক শ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে পথভ্রষ্ট করার উদ্দেশ্যে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং উহাকে(আল্লাহর পথ) নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করে। এদের জন্যে রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।' (সূরা লুকমান ৩১: ৬ আয়াত)
আল-ওয়াহিদি (রাঃ) এবং অন্যান্য তাফসীরকারগণ ব্যাখ্যা করেন যে, এই আয়াতে “অবান্তর কথাবার্তা” বলতে গান সঙ্গীতকে বুঝানো হয়েছে।
অশ্লীলতা ও বেহায়াপনায় পূর্ণ এরূপ অনুষ্ঠানে যোগদান করা এবং আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা ইসলামের দৃষ্টিতে অসভ্য কাজে সাহায্য করারই নামান্তর।
আর আল্লাহ তাআলা বলেছেন, 'তোমরা নেকী ও তাক্বওয়ার কাজে পরস্পরকে সাহায্য কর এবং গোনাহ ও সীমালংঘনের কাজে সাহায্য করো না।' (মায়েদাহ, আয়াতঃ ০২)
valo lagse pore
ReplyDelete