ক্বারিন জ্বীন - তৌহিদ রাসেল
ক্বারিন জ্বীন
- তৌহিদ রাসেল
ক্লাস টেনের প্রি-টেস্ট পরীক্ষার আগে হুট করে ড্যান্স একাডেমিতে যাওয়া ছেড়ে দেওয়ার পাশাপাশি ড্যান্স করাই ছেড়ে দিলাম। বাবার কথা মত নিয়মিত নামায পড়া শুরু করলাম।
একদিন এশার নামাজের জন্য বাসা থেকে বের হয়ে মসজিদে যাচ্ছিলাম। তো মাঝখানে একটা জায়গায় এক বাড়ির সামনের সিড়িতে বসে বন্ধু সুমনসহ বেশ কয়েকজন মোবাইল টিপাটিপি করার পাশাপাশি আড্ডা দিচ্ছিলো।
কেউ যখন নতুন নতুন নামায ধরা শুরু করে তখন নামাযের জন্য হাতের নাগালে যাকে পায় তাকেই নামাযে নেওয়ার জন্য জোরাজোরি করে। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। সেদিন সুমনসহ সবাইকে বললাম আজান দিছে চল সবাই নামায পড়ে আসি।
এই কথা শুনে সুমন আমাকে ধমক দিয়ে বললো 'ঐ বেডা তুই ফাইজলামি পাইছস! একটু আগে না বললি যে নামাযে যাইতে আমাগো, আবার আইছস ক্যান হুদাই!'
আমি বললাম 'কখন আসলাম। আমিতো মাত্রই বাসা থেকে বের হয়ে আসলাম।' এই কথা শুনে সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে বললো 'ঐ কয় কি এগুলা!'
সুমনকে বললাম যে 'দেখ দোস্ত আমি মজা করতেছিনা। আর নামাজে যাওয়ার সময় কেনই বা মিথ্যা বলবো! আমি মাত্রই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম সত্যি করে বলতেছি।'
তখন সুমন সহ সবাই একটু চমকালো। বললো তাহলে একটু আগে তোর মত কে আমাদের নামাযে যাওয়ার কথা বললো!' সবাই তখন বিষয়টা সিরিয়াসলি নিলো। ওদের মুখে শোনার পর আমার ভয় ভয় লাগতেছিল যে কে আমার সুরতে ওদের কাছে আসলো! আমাকে একা পেলে ক্ষতি করবে না তো কোনো কিছুতে!
নামায পড়ার পর, সন্ধ্যা হলে, একা কোথাও গেলে এমনকি ঘুমানোর সময় ঘুমানোর দোয়া পড়ার আগে আয়াতুল কুরশি পড়ে ফু দিয়ে তারপর ঘুমাইতে যেতাম।
হাই স্কুল জীবনের আরেকটা ঘটনা মনে আছে। আমি ক্লাস এইট থেকে রাত গভীর অবধি জাগতাম। বিশেষ করে রেডিওর নাইট প্রোগ্রামগুলি শুনার কারণে এই অভ্যাস হয়েছিল। তো একদিন রাত আনুমানিক ২ টার মত হবে আমি টেবিলে বসে সম্ভবত হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের কোনো রোমাঞ্চকর এডভেঞ্চার টাইপ উপন্যাস পড়তেছিলাম।
হুট করে ধমকের শব্দ কানে আসলো দূর থেকে। ধমকের শব্দ আমার ছোট ভাই নয়নের কণ্ঠের মত। অথচ নয়ন আমার রুমে নিশ্চিন্তে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। পাশের বাসার আন্টি চিল্লাইয়া উঠলো এবং বলতেছে 'রাসেল! ও রাসেল! তোদের নয়ন আমাকে এত রাতে ধমক দিয়ে কই গেল!'
আমিতো দৌড়াইয়া বের হয়ে বললাম কাকী ধমকের শব্দ আমিও শুনেছি। কিন্তু নয়ন তো আমার রুমে ঘুমাচ্ছে। আন্টিতো চিন্তায় পরে গেলো। শুধু আন্টি না আমারও চিন্তা হচ্ছিলো যে নয়ন ঘুমাচ্ছে অথচ ওর কন্ঠের মত সাউন্ড। কই থেকে এবং কিভাবে আসলো!
এই রকম অনেক ঘটনার কথা মানুষের মুখে শুনেছি। যেমন পরিচিত কেউ মাছ মারার কথা বলে রাতে কাউকে ডেকে নিয়ে পানিতে চুবাইছে। আবার ছোটপোলাপানদের অনেককেই আমের দিনে আম কুড়ানোর জন্য পাশের বাসার কারো বেশ ধরে এসে ডাক দিয়ে নিয়ে গিয়ে পুকুরে চুবাইতো বা কাদার মাঝে পুতে রাখতো।
উত্তর ছত্রভোগের একটি ঘটনা। একটা মেয়ে কোনো একটি কারণে নাকি একটি ঝুপ টাইপের বাগানে গাছের সাথে ফাঁস ফিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। ঐ বাগানের পাশ দিয়ে মানুষের আসা যাওয়ার রাস্তা। অনেকেই নাকি ঐ মেয়েটাকে ঐ রাস্তায় দিয়ে দ্রুত বাগানের দিকে চলে যেতে দেখছে। এছাড়াও ঐ মেয়ের পরিচিত অনেক রিলেটিভ নাকি ঐ বাগান থেকে ঐ মেয়ের কন্ঠের কান্না ভেসে আসতে শুনছে।
এখন কথা একটি মানুষের অস্তিত্ব দুই জায়গায় কিভাবে বিদ্যমান হয়! অথবা যে মানুষ পৃথিবী থেকে চলে গিয়েছে পরকালে সেই মানুষই বা আবার ইহকালের মানুষদের সাথে কিভাবে বিভিন্ন ভণিতায় সাক্ষাত দেয়!
এর কোনো ব্যাখা বিজ্ঞানের কাছে আছে? বিজ্ঞান এসব বিষয়কে অমুলক বলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিবে। বিজ্ঞান বলবে এগুলো নিছক চিন্তাধারা থেকে তৈরি ক্ষণিক কাল্পনিক চিত্র। অথবা বিজ্ঞান বলবে এটা ব্যক্তির হেলুসিনেশনের কারণে এমনটা হয়েছে।
আচ্ছা তাই যদি হয় তাহলে একই জায়গায় একই মানুষকে একের অধিক মানুষ কিভাবে দেখে। অথচ উক্ত ব্যক্তির অস্তিত্ব পৃথিবী থেকে মুছে গেছে অনেক আগেই।
এই বিষয় জানার জন্য মোয়াজ্জেম ভাইয়ের নিকট গেলাম। তিনি হেসে দিয়ে বললেন, আরে এগুলা তো ক্বারিন জ্বীনের কারসাজি। আমি বললাম 'ক্বারিন জ্বীন আবার কী!' তখন তিনি মোটামুটি ক্বারিন জ্বীন নিয়ে বলতে শুরু করলেন।
প্রত্যেক মানুষের সাথে দিনে ২ জন আর রাতে ২ জন ফেরেশতা থাকেন, আর থাকে 'ক্বারিন' নামক এক শয়তান জ্বীন। ক্বারিন জ্বীনের কাজই হল মানুষের সাথে থেকে তাকে কুমন্ত্রণা দেয়া। সব মানুষের সাথেই ক্বারিন জ্বীন থাকে, এমনকি আমাদের নবী (সা:) এর সাথেও ছিল। তবে আল্লাহপাকের বিশেষ রহমতে রাসূল (সা:) এর ক্কারিন জ্বীন ছিল ভাল।
একজন মানুষের সাথে সবসময় থাকার কারনে এই ক্বারিন জ্বীন মানুষের সকল কাজ, আর তার নাড়ি-নক্ষত্র সম্পর্কে অবগত থাকে। যেমন কোন গণক বা ফকিরের কাছে গেলেন, আর সে আপনাকে দেখে বললো, 'তুই তো গত সপ্তাহে এই এই কাজ করেছিস'। আপনি শুনে হয়তো অবাক হয়ে ভাববেন 'সে তো সত্যি কথাই বলেছে!'
কিন্তু আসলে কোন ফকির বা গণকের এসব জানার ক্ষমতা নেই, তারা সেই মানুষটির ক্বারিন জ্বীনের সাথে যোগাযোগ করে এর মাধ্যমে জেনে বলে দেয়। তবে গায়েবী বা অদৃশ্য খবরগুলো জানার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া মানুষ বা জ্বীন কারোর নেই। যেমন সুলাইমান (আ:) এর ইন্তেকালের অনেক দিন পরেও জ্বীনরা বুঝতে পারেনি যে তিনি আর নেই, যতক্ষণ না উইপোকা তাঁর হাতের লাঠি খেয়ে ফেলার কারনে তিনি পড়ে গিয়েছিলেন।
যারা শয়তানের পূজারী হয় তাদের বিভিন্ন কাজে শয়তান সাহায্য করে, যাতে এগুলোকে কারামতি বা অলৌকিক ঘটনা মনে করে মানুষ তার ভক্ত হয়ে যায় আর শয়তানের অনুসারীতে পরিনত হয়। জ্বীনদের অনেক বৈশিষ্ট্যের একটি বৈশিষ্ট্য হল তারা মানুষসহ যেকোন প্রানীর রূপ ধারন করতে পারে, শুধুমাত্র রাসূল (সা:) এর রূপ ছাড়া। তাছাড়া অদৃশ্য থেকেও জ্বীনরা বিভিন্ন কথা বলতে বা শব্দ করতে পারে।
কেউ যখন মারা যায় বা আত্মহত্যা করে, তখন তার ক্বারিন জ্বীন সঙ্গীহারা হয়ে যায়। তখন সে মাঝেমাঝে মৃত ব্যক্তির রূপ নিয়ে চলাফেরা করে, এমনকি মৃত ব্যক্তির রূপ নিয়ে জীবিতদের সামনে আসে। সে এমনসব কথা বলে বা তথ্য দেয় মনে হবে যেন মৃত ব্যক্তিই এসেছে। শুধু ক্বারিন জ্বীনই নয়, মৃত ব্যক্তির রূপ নিয়ে অন্য কোন জ্বীন বা শয়তানও আসতে পারে। মোটকথা, তাদের সবারই উদ্দেশ্য হল মানুষকে কষ্ট দেয়া, ভয় দেখানো, বিভ্রান্ত করা বা ঈমানকে ভূলপথে নিয়ে যাওয়া।
কুরআন-হাদিস অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির আত্মা পৃথিবীতে ফিরে আসেনা এটা বিশ্বাস করাই হল ঈমান, কিন্তু জ্বীন বা শয়তান মানুষের মনে আত্মা ফিরে আসার ভূল ধারণা ঢুকিয়ে দেয়। শয়তান বা জ্বীন দূর্বলচিত্ত মানুষদেরকেই ভয় দেখায় বা তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করে বেশি।
মোয়াজ্জেম ভাইয়ের কাছে এসব অতিপ্রাকৃতিক চিনিস নিয়ে প্রায় উপস্থিত হতাম। তিনি কিছুক্ষণ ভেবে তারপর গল্প জমিয়ে দিতো। ক্লাস টেনে আমি গভীর রাতে উঠে যখন ঘরের বাইরে যেতাম বিশেষ করে প্রসাবখানায় তখন বাড়ির পাশের বড়ই গাছ থেকে একটি পাখি ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে যেত। একদিন মোয়াজ্জেম ভাইকে ফোন দিয়ে ঘুম থেকে উঠিয়ে এটা দেখিয়েছিলাম। সেটারও সে ব্যাখ্যা দিয়েছিল। সেটা না হয় আরেকদিন বলা যাবে।
এখন ক্বারিন জ্বীন সমন্ধে কুরআন হাদিসের আলোকে আরও কিছু বলা যাক। ক্বারিন আরবি শব্দ। এর অর্থ হল- সঙ্গী, সাথী ও সহচর।
কুরআন ও সহিহ সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত যে, প্রতিটি মানুষের নিকট একজন করে জ্বীন-শয়তান নিযুক্ত করা আছে। তার কাজ মানুষকে পথভ্রষ্ট করা, অন্যায়, অশ্লীল ও কুকর্মে প্ররোচিত করা এবং ভালো কাজে নিরুৎসাহিত করা বা বাধা দেয়া। একেই ক্বারিন বা সহচর শয়তান বলা হয়।
রাসুল (সাঃ) এর নিকটও এই জ্বীন-শয়তান ছিল কিন্তু সে ইসলাম কবুল করেছিলো। যার কারণে সে নবী (সাঃ) কে কুমন্ত্রণা দিতে সক্ষম হত না। রাসুল (সাঃ) বলেছেন- “তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যার সাথে তার সহচর জ্বিন বা শয়তান নিযুক্ত করে দেয়া হয়নি।
সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন: আপনার সাথেও কি হে আল্লাহর রাসূল?
তিনি বললেন- আমার সাথেও তবে আল্লাহ তা'আলা তার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করেছেন। সে আমার অনুগত হয়ে গেছে। ফলে সে আমাকে কেবল ভাল কাজেরই পরামর্শ দেয়।”
কুরআনেও আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন মানুষের সার্বক্ষণিক সঙ্গী এই শয়তান এবং মানুষের মাঝে বাক-বিতণ্ডার কথা উল্লেখ করেছেন, 'তার ক্বারিন বা সঙ্গী শয়তান বলবে: হে আমাদের পালনকর্তা, আমি তাকে অবাধ্যতায় লিপ্ত করিনি। বস্তুত: সে নিজেই ছিল সুদূর পথভ্রান্তিতে লিপ্ত। আল্লাহ বলবেন: আমার সামনে বাকবিতণ্ডা করো না। আমি তো পূর্বেই তোমাদেরকে আজাব দ্বারা ভয় প্রদর্শন করেছিলাম।' (সূরা ক্বাফ: ২৭ ও ২৮)
অনেকের মনেই প্রশ্ন যে, জ্বীন আর শয়তান কি একই, এদের কি মৃত্যু হয়?
হ্যাঁ, জ্বিন ও শয়তান একই জাতি বা একই ধরনের সৃষ্টি। আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালা কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘শয়তান মূলত জ্বীন জাতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।’
জ্বীন জাতির মধ্যে শয়তান থাকে, তবে সব জ্বীনই শয়তান নয়। মানবজাতির মধ্যে যেমন ভালো-মন্দ আছে, তেমনি জ্বীনদের মধ্যেও ইমানদার আছে, আবার বেইমানও আছে।
মানুষের জন্য যেমন মৃত্যু অবধারিত একটি বিষয়, অনুরূপভাবে জ্বীন ও শয়তানদের জন্যও অবধারিত একটি বিষয়। আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'প্রত্যেক প্রাণই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আমি তোমাদের ভালো ও খারাপ অবস্থা দিয়ে পরীক্ষা করি। আর আমারই কাছে তোমাদের ফিরে আসতে হবে।' (সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৩৫)
অসাধারণ হয়েছে। আরোনকিছু বিষয় যুক্ত করে বই আকারে প্রকাশ করতে পারেন।
ReplyDelete