যাদের রোজা না রাখার বিধান


গ্রামে যারা ধানের চাষ করে তাদের সবচেয়ে ব্যস্ততম সময় হলো বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস। বাংলাদেশে এই সময় গরমটাও পড়ে চরম। গ্রামের মানুষ বলে 'কুত্তা মরা গরম'।

যারা ধান কাটে তারা ফজরের পরেই ক্ষেতে যাওয়া শুরু করে দুপুর অবধি ধান কেটে মাথায় করে ইয়া বড় বড় ধানের বোঝা 'খৈলানে' নিয়ে আসতে আসতে বিকেল গড়ায়। গ্রামে ধান মাড়াইয়ের উঠানকে খইলান বা খৈলান বলে, একেক এলাকায় একেক নামে পরিচিত। এরপর সেই ধান মাড়াই করে বস্তায় ভরতে ভরতে প্রায় সন্ধ্যা অথবা রাত হয়ে যায়। এই পুরোটা সময় তাদের শরীর থেকে অঝর ধারায় ঘাম ঝরতে থাকে।

যারা ধান কাটে তাদের কি পরিমাণ পানি খেতে হয় একমাত্র এই ধান কাটার সময় পাশে যে থাকে সে জানে অথবা যে ধান কাটে সে জানে। যারা ধান কাটে তারা অনেক বেশি পরিমাণে ভাত খায় প্রচুর খিদা লাগে। এছাড়াও টুকিটাকি অনেক কিছুই হয়তো খায়।

ছোটবেলায় নদীরপার প্রতিদিনই দেখতাম যে বোটে করে অনেক ইট এবং বালু আসতো। যারা এই ইট-বালু বোট থেকে নামাতো তাদের অবস্থাও সেই ধান কাটা লোকদের মত অঝর ধারায় ঘাম ঝরতে থাকতো। তাদেরও প্রচুর পানি এবং অন্যান্য খাবার খেতে হত।

মাটিকাটার কাজে  নিয়োজিত লোকদেরও একই অবস্থা। গ্রামে-গঞ্জে অথবা শহরে যারা মালামাল শরীর দ্বারা বহন করে তাদের সবাইর অবস্থা একই রকম।

গ্রামে আজকাল প্যাডেলের রিক্সা প্রায় উঠে গেছে। সবাই মোটরচালিত রিক্সা চালায়। কষ্ট অনেক কমে গেছে। কিন্তু শহরে মোটরচালিত রিক্সা নেই বললেই চলে, অধিকাংশ রিক্সাওয়ালাই প্যাডেলচালিত রিক্সা চালায়। গ্রামে বা শহরে যারা প্যাডেলের রিক্সা অথবা ভ্যান চালায় তারা জানে এটি কত কষ্টকর।

সারাবছর সকালবেলায় শহরে বা গ্রামে কিছুলোককে দেখতাম মর্নিং ওয়াক করতে বের হতো। হালকা দৌড়াতো। রোজার দিনে তাদের আর দেখা যায় না। এই যে যারা মর্নিং ওয়াক করে তারা জানে যে এই এক দেড়ঘন্টা দৌড়ানোর পর অথবা হাটার পর কি পরিমাণ পানি তৃষ্ণা লাগে, কি পরিমাণ ঘাম শরীর থেকে বের হয় এবং তারা যদি পানি পান না করে অনেকেই হয়তো জায়গায় ফিট হয়ে পড়ে থাকবে। এই কারণে রমযানে মর্নিং ওয়াকের মানুষ দেখা যায় না।

কি নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি তা অনেকেই হয়তো আঁচ করতে পেরেছেন। জ্বি হ্যা রিক্সাওয়ালা নিয়ে বিতর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাচ্ছিলাম। এতক্ষণ এত কথা টেনে আনার এই কারণ যে নিজের ভিতরে যেন অনুভব হয়।

বাংলাদেশের একজন বক্তা একটি কথা বলে বেশ আলোচিত এবং সমালোচিত হয়েছেন। তিনি কষ্টের কাজ করার মানুষদের ব্যাপারে রোজা রাখার বিধান বলতে গিয়ে রোজা রাখতে বেশি কষ্টকর হয়ে গেলে রোজা না রাখার ব্যাপারে মত দিয়েছেন। বিশেষ করে রিক্সাওয়ালাদের উদাহরণ টেনে এনেছেন।

অত্যধিক দৈহিক পরিশ্রমী মানুষদের ব্যাপারে অনেক আগেই ফতোয়া পড়েছিলাম। বিশেষ করে কুরআনের ব্যাখ্যা। উক্ত বক্তা যে কথা বলেছেন তার কয়েকদিন আগেও আমি কুরআনের অনুবাদ পড়তে গিয়ে এই বিষয়টি আবারও জেনেছি।

অনলাইনে যারা কুরআন পড়েন তাদের নিকট Quraanshareef.  org বেশ জনপ্রিয়। সেখানে রোজা না রাখা ব্যাপারে সূরা বাক্বারার ১৮৪ নং আয়াতে যেটুকু বলা আছে তা হলো- 'তোমাদের মধ্যে যে অসুখে থাকবে অথবা সফরে থাকবে, তার পক্ষে অন্য সময়ে সে রোজা পূরণ করে নিতে হবে। আর এটি যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্ট দায়ক হয়, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্যদান করবে।'

এই জায়গায় রোজা না রাখার ব্যাপারে দুটি অংশে বিভক্ত। আর এর কারণ অবশ্যই আছে বলে দুটি অংশে বিভক্ত।

আমার কাছে বেশকিছু বাংলা অনুবাদের কুরআন আছে। সময় পেলে মাঝেমাঝে পড়ি আর রমজানে নিয়মিত পড়ার চেষ্টা করি। রোজার প্রথম দিকেই সূরা বাক্বারা শেষ হয়। আর বাক্বারা সূরাতেই রোজা নিয়ে কয়েক জায়গায় আলোচনা করা হয়েছে এবং যেহেতু রমযান মাস চলতেছে সেহেতু রোজার আয়াতের অনুবাদের প্রতি মনোযোগ একটু বেশিই ছিল।

এই রমযানে কুরআনের যে অনুবাদটি পড়তেছিলাম  তা হলো 'কুরআন রিসার্চ ফাউন্ডেশন' কর্তৃক অনূদিত 'আল কুরআন: যুগের জ্ঞানের আলোকে অনুবাদ'

সেখানে রোজা না রাখার ব্যাপারে যে অনুবাদ করা হয়েছে তা হলো- 'তবে তোমাদের কেউ অসুস্থ অথবা সফরে থাকলে সে অন্য দিনগুলোতে এই সংখ্যা পূর্ণ করবে; আর যারা তা পালন করতে অতিকষ্টে সক্ষম {কিন্তু অতিমাত্রায় কায়িক পরিশ্রম করে জীবিকা অর্জনকারী এবং বয়সের ভারে ন্যুজ্ব ব্যক্তিগণ সিয়াম পালন করতে না পারায়} তারা প্রতি সওমের জন্য একজন মিসকিনের খাবার 'ফিদিয়া' হিসেবে প্রদান করবে।'

এছাড়াও এই কুরআন অনুবাদের ইন্ডেক্সেও এই ব্যাপারে দেওয়া আছে। এটা পড়েছিলাম কিছুদিন আগে তার কয়েকদিন পর উক্ত বক্তা এই একই কথা বলতে গিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন। তিনি বেশকিছু উদাহরণও দিয়েছেন। যেমন- মরুভূমিতে কাজ করা এবং ডিহাইড্রেশনের অভাব দেখা দেওয়া ইত্যাদি।

এখন কথা হলো রোজা না রাখার ব্যাপারে যেহেতু কুরআনের আয়াত আছে তবুও কেন এত বিতর্ক! অনেকেই বলছে যে একজন রিক্সাওয়ালা তো নিজেই খেতে পায় না সে আবার একজন মিসকিনকে কি খাওয়াবে। যদি মিসকিনকে খাওয়াতেই পারে তাহলে ঘরে বসেই তো রোজা পালন করতে পারে।

অনেকেই বলেছে যে- বদর অথবা ওহুদ যুদ্ধের চেয়েও কি রিক্সা চালানো কষ্টের নাকি। তাদের জেনে রাখা উচিৎ যে, আনাস (রা:) যখন রোজা রাখায় অসামর্থ্য হয়ে পড়েছিলেন তখন তিনি ফিদিয়া দিয়েছিলেন।

'ফিদিয়া' দেওয়া এবং না দেওয়ার ব্যাপারেও মত রয়েছে। তাফসির ইবনে কাসিরে যাদের ফিদিয়া দেওয়ার সামর্থ্য নেই তারা ফিদিয়া দিবে না ব্যাখ্যা করা আছে এবং সেখানে কুরআনের আরেকটি আয়াত এনে বলা হয়েছে যে 'আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে কোনো কাজ চাপিয়ে দেন না'।

আমাদের অনেকেই আছে যে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও রোজা রাখেনা। আবার অনেকেই সফরে বা অসুস্থ থাকা অবস্থাতে রোজা রাখে এবং কিছু নাবালক শিশুরাও রোজা রাখে। সূরা বাক্বারার ১৮৪ নং আয়াতের শেষে বলা হয়েছে- 'আর যদি রোজা রাখ, তবে তোমাদের জন্যে বিশেষ কল্যাণকর, যদি তোমরা তা বুঝতে পার'। আল্লাহ সূরা বাক্বারার ২৮৬ নং আয়াতে বলেছেন- 'সে যা ভালো কাজ করেছে তার ফল পাবে এবং যা খারাপ করেছে তা তার বিরুদ্ধে যাবে'।

আমি কোনো আলেম না এবং ইসলামিক স্কলারও না। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত একজন মানুষ এবং আমি উক্ত বক্তাকে ডিফেন্ড করেও বলতেছিনা। মূলত বক্তার উক্ত কথা শোনার আগেই এই বিষয় একটু জানা ছিল বলে এবং এখন এই বিষয়টি ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে দু'কলম লিখলাম। আমার কাছের পরিচিত বা অপরিচিত অনেক ব্যক্তির নিকট এটি গ্রহণযোগ্য নয়। গ্রহণযোগ্য না হলে গ্রহণ করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। যার যার হিসাব তার তার দিতে হবে।

কেউ ভুল করলে তাকে ভুল জানিয়ে দিয়ে সচেতন করাই উত্তম। যদি একটি জিনিস সত্য হয়ে থাকে তাহলে তা গোপন করা উচিৎ নয়। আল্লাহ বলেন- তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিও না এবং জানা সত্ত্বেও সত্যকে গোপন করো না'। আর যদি একটি বিষয়ে বিভিন্ন মত থাকে তাহলে অপর মতকে শ্রদ্ধা করার মনমানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। একজন জ্ঞানী কখনো অপর মতকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেনা।

আমরা যারা দৈহিক কঠোর পরিশ্রমের মানুষদের রোজা না রাখার পক্ষে অথবা বিপক্ষে তাদের ভিতর আমাদের উচিৎ হবে রোজা রাখা অবস্থায় টানা ২৯/৩০ দিন ধান কাটা, মাটিকাটা, ইটবালু টানা অথনা রিক্সা চালানো। তাহলে তা আমাদের খুব সহজেই বোধগম্য হবে যে দৈহিক কঠোর পরিশ্রমীদের রোজা রাখতে হবে নাকি না!

'আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে কোনো কাজ চাপিয়ে দেন না'। [সূরা বাক্বারাহ, আয়াত: ২৮৬]

সামছুর রহমান ওমর বলেছেন- 'কোন অবস্থাতেই কিছু ভুলের কারনে/ভিন্ন মত পোষন করার কারণে অন্য আলিমকে কটাক্ষ করা, তীব্র সমালোচনা করা বাঞ্ছনীয় নয়। মনে রাখতে হবে, তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে মানুষ অনেক বেশি সচেতন। অন্যকে অন্যায়ভাবে আক্রমণ করা হলে মানুষের মধ্যে তার প্রতি সহমর্মিতা বাড়ে, পরিচিতি বাড়ে। তার প্রতি মানুষ আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠে। অন্যদিকে অযৌক্তিক কটুক্তিকারি/সমালোচনাকারীদের গ্রহনযোগ্যতা কমে। সাধারন মানুষ তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষন করে। তাদের প্রতি আস্থা হারায়।'

আমি সচরাচর বিতর্কিত বিষয় নিয়ে কিছু লিখিনা। কারণ এতে অনেক কাছের ভাই-ব্রাদার বিরোধী পক্ষ ভেবে দূরে সরে যায়। আমি বিতর্কিত বিষয়ের চেয়ে পারস্পারিক সম্পর্ককে বেশি প্রাধান্য দেই। দয়া করে ভুল বুঝে কেউ দূরে সরে যাবেন না।

যারা উক্ত বক্তা অথবা আমার এই লেখার সাথে দ্বিমত তাদের মতকেও আমি শ্রদ্ধা করি এবং সবারই উচিৎ ভিন্ন মতকে শ্রদ্ধা করা। হুট করে রাগ হওয়া অথবা অন্তরে ঘৃণা পোষণ করা ঠিক নয়। হুট করে রাগ হওয়া অথবা অন্তরে ঘৃণা পোষণ করা রাসুল (সা:) কোনো গুণ নয়। ভুলত্রুটির জন্য সকলের নিকট ক্ষমাপ্রার্থী এবং আল্লাহ যেন আমাদের ভুলগুলো শোধরানোর তৌফিক দান করেন। আমিন।

শেষ করার আগে সূরা বাক্বারার ১৮৪ নং আয়াতের সহজ সরল অনুবাদটি আবারও দিয়ে দিচ্ছি- 'গণনার কয়েকটি দিনের জন্য অতঃপর তোমাদের মধ্যে যে অসুখে থাকবে অথবা সফরে থাকবে, তার পক্ষে অন্য সময়ে সে রোজা পূরণ করে নিতে হবে। আর এটি (সওম) যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক হয়, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্যদান করবে। যে ব্যক্তি খুশীর সাথে সৎকর্ম করে, তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যদি রোজা রাখ, তবে তোমাদের জন্যে বিশেষ কল্যাণকর, যদি তোমরা তা বুঝতে পারো'।

Comments

Popular posts from this blog

সমকাম বা হোমোসেক্সুয়াল

বিভিন্ন ধর্মে নারীর পর্দা- তৌহিদ রাসেল

এক নজরে দোহার উপজেলা