জাতিভেদ কিংবা শ্রেণিভেদ


ছোটবেলার একটি ঘটনা মনে পড়লো। ঘটনাটি বিয়ে নিয়ে। আমাদের এলাকার এক মেয়েকে পছন্দ করতেন অন্য এলাকার এক ছেলে এবং মেয়েটিও তাকে পছন্দ করতেন। ছেলেটি যথেষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন। তাই প্রেমের ঝামেলা না বাড়িয়ে সে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন।

সবঠিক ঠাক। কিন্তু হঠাৎ বিয়ে ভেংগে গেল। মেয়ের ফুপু বিয়েতে ভেটো দিলো। বললো- ছেলেরা জুলা, জুলা বাড়িতে আমাদের মেয়ে বিয়ে দিব না। সমাজে আমাদের একটা সম্মান আছে না!

আমি তখন জানতাম না জুলা কি জিনিস। একদিন মেঘুলা বাজারের রিফাত লাইব্রেরিতে বই কেনার সময় দেখি একটি গল্পের বই, নাম 'জুলা ও সাত ভূত'। বই কিনলাম, পড়লাম। জুলা কিভাবে ভূতদের কুপোকাত করে তা জানতে পারলাম। কিন্তু জুলা কি তা জানতে পারলাম না।

তবে জানতে পেরেছি অনেক পরে। এলাকার এক ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি বলেছিলেন- যারা তাঁতের কাজ করে তাদের জুলা বলে। আর যারা জমিজমা চাষ করে তাদের গৃহস্থ অর্থাৎ গেরস্থ বলে। জুলাদের নিচু ভাবে দেখা হয় বলে গৃহস্থরা জুলাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক করেনা।

শোনে তো আমি 'থ'। তাঁতের কাজ এমন কি জিনিস যে, এই পেশার মানুষদের নিচু করে দেখা হবে!

আমি জানিনা দোহারের বাইরে অন্যান্য জায়গায় এই সমস্যা আছে কি না। হয়তো অন্য কোনো এলাকায় অন্য পেশার ভিত্তিতে উঁচু নিচু তফাৎ করা হয়।

তাঁত শিল্প সমন্ধে আমাদের হয়তো অনেক কিছু জানা নেই। ইতিহাসের পাঠ থেকে আমরা তথ্য জেনে গর্ব করে বলি - 'হুম! আমাদেরও বিখ্যাত মসলিন কাপড় ছিল, যা দেশ বিদেশে বিখ্যাত ছিল'। এই গর্বিত জাতির অনেকে জানেই না যে মসলিন কাপড় তাঁতশিল্পেরই একটা প্রোডাক্ট।

দোহারের বাইরে জয়পাড়া ও মালিকান্দা লুঙি খুবই বিখ্যাত এবং দামও অনেক। দোহারের অনেকেই হয়তো এটা নিয়ে গর্বও করে। কিন্তু দিন শেষে এই পেশার মানুষদের নিচু করে দেখে। কেন ভাই কেন! তোমরা এত হিপোক্রিট কেন!

একজন মুসলিমের জেনে রাখা উচিৎ কৃষি কাজের পাশাপাশি আদম (আঃ) এর পেশা ছিলো তাঁত আর রাসূল (সাঃ) এর কাপড়ের ব্যবসা ছিলো।

এই যে বিভিন্ন সমাজে পেশার ভিত্তিতে মানুষকে উঁচু নিচু ভাবা হয় এটা কিন্তু আজকালকার ঘটনা না। এটি সেই প্রাচীণ যুগে তৈরি করা এক বর্বর শ্রেণি বিন্যাস এবং নিকৃষ্ট জাতিভেদ প্রথা।

প্রাচীণ ভারতীয় উপমহাদেশে আর্যরা যখন এসে ক্ষমতার মসনদে আসীন হয় তখন থেকেই তারা এই জাতিভেদ প্রথার প্রচলন করে। তারা বিভিন্ন মানুষের পেশার ভিত্তিতে শ্রেণিবিন্যাস করে। এটি আরো প্রকট আকার ধারণ করে মূলত সেন রাজশাসনের সময়। জাতিভেদ প্রথার আরেক রূপ হলো কৌলিন্য প্রথা, যার জনক বলা হয় বল্লাল সেনকে।

হিন্দু সমাজে অনেকগুলো শ্রেণিবিন্যাস প্রচলিত ছিল। তার ভিতর ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র অন্যতম। সমাজে শূদ্রদের এতই নিচু ভাবে দেখা হতো যে যা বলার বাইরে এবং তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ বেদ পর্যন্ত পড়ার অধিকার ছিল না। তথ্যটা সঠিক কি না কোনো হিন্দু ভাই লেখাটি পড়ে থাকলে জানাবেন।

এখন আধুনিক যুগে হয়তো সেই প্রাচীণ জাতিভেদ প্রথা উঠে গেছে, কিন্তু আমরা জাতিগতভাবে তো সেই ভূখণ্ডেরই মানুষ। আমাদের মাঝে আজও সেই জাতিভেদ প্রথা রয়ে গেছে তবে তা ভিন্ন নামে এবং ভিন্ন পন্থায়।

আধুনিক যুগে কৃষ্ণাঙ্গ ও শেতাঙ্গ বর্ণবাদ প্রথা তো বিশ্বে ব্যাপাক আকার ধারণ করেছিল। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় ধনী-গরীব-মধ্যবিত্ত সে তো শ্রেণিভেদের দৃষ্টান্ত উদাহরণ।

জাতিভেদ অর্থাৎ শ্রেণিবিন্যাস নিয়ে লিখে রুশো এবং কার্ল মার্কসরা বিখ্যাত হয়ে গিয়েছেন। সমাজতন্ত্রও কায়েম হয়েছিল বিভিন্ন দেশে। কিন্তু শ্রেণিভেদ কি দূর হয়েছে!

হয়নি। হবেই বা কেমন করে। জাতিভেদ চিন্তাধারা যে আমাদের জিনগত ব্যাপার হয়ে গিয়েছে।

আজকাল শিক্ষিত সমাজের মাঝেও শ্রেণিভেদ দেখা যায়। আমি হুজুর ও তো জেনারেল, ও ইসলামের কি বুঝে! অথবা আমি জেনারেল ও তো হুজুর, ও সাইন্সের কি বুঝে!

হুজুরদের মাঝেও শ্রেণিভেদ আছে। আমি কওমি ও তো আলিয়া অথবা আমি আলিয়া ও তো কওমি।

জেনারেলদের মাঝেও রয়েছে ব্যাপক শ্রেণিভেদ। আমি পাবলিকের স্টুডেন্ট আমার চেয়ে ন্যাশনাল, প্রাইভেটের পোলাপান বেশি বুঝে নাকি ইত্যাদি ইত্যাদি।

কাজকর্মের শ্রেণিভেদের দিকে না হয় আর নাই গেলাম। এই যে এত এত শ্রেণিভেদ এগুলো কি দূর করা যায় না!!

হ্যা যায়। আবার যায় না। আমি যদি নিজে এই শ্রেণিভেদ চিন্তাধারা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখি এবং সমাজে বা আমার সার্কেলের মানুষদের তফাৎ করে না দেখি এবং  অন্তত এসব বিষয় পরিচিত সবাইকে বুঝাই তাহলে শ্রেণিভেদ কিছুটা হলে দূর হবে। পরিবারের উপর বেশি জোর দিতে হবে। পরিবার থেকে একজন সন্তানের চিন্তাধারা সেট আপ হয়।

আলহামদুলিল্লাহ আমার বাবা মা এদিক থেকে খুব পজিটিভ ছিলেন। এমনকি অন্যধর্মালম্বীদের সাথেও কখনো বৈষম্য করে চলার শিক্ষা কখনো দেন নি। সে বিষয় নিয়ে অন্য আরেকদিন লিখবো। আর আমি যদি নিজে থেকে মুক্ত না হয়ে বলি অন্যরা মুক্ত হোক, তাহলে শ্রেণিভেদ কখনই দূর করা যাবেনা।

আমরা যতই বলিনা কেন আমরা মুক্তমনা, আমরা অসাম্প্রদায়িক কিন্তু আমাদের মাঝে অস্পষ্ট এক দেয়াল ঠিকই দাঁড়িয়ে আছে।

আমাদের এই স্পষ্ট দেয়াল উপড়ে ফেলতে হবে। মানুষকে মানুষ ভাবতে হবে। অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণ করতে হবে। মানুষের মাঝে ভেদাভেদ দূর করে একই কাতারে দাঁড়িয়ে ভালবাসা বিলাতে হবে।

রাসুল (সা:) বলেন- 'কোন অনারবের উপর কোন আরবের, কোন আরবের উপর কোন অনারবের উচ্চ মর্যাদা নেই। একজন শেতাঙ্গ একজন কৃষ্ণাঙ্গের তুলনায় এবং একজন কৃষ্ণাঙ্গ একজন শেতাঙ্গের তুলনায় উচ্চতর নয়।'

Comments

Popular posts from this blog

সমকাম বা হোমোসেক্সুয়াল

বিভিন্ন ধর্মে নারীর পর্দা- তৌহিদ রাসেল

এক নজরে দোহার উপজেলা