সাইকোলজিক্যাল ড্রিম বা মনস্তাত্ত্বিক স্বপ্ন - তৌহিদ রাসেল





সাইকোলজিক্যাল ড্রিম

তৌহিদ রাসেল




সাফিয়া তার স্বপ্নে দেখে তার এক জায়গায় যে টাইমে যাওয়ার কথা সেই টাইম পার হয়ে গেছে কিন্তু সে অন্যকোনো কাজে আটকা পড়ে গেছে বিধায় উক্ত জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি। অথবা গিয়েছে কিন্তু সময়ের শেষ মুহূর্তে।


সাফিয়ার সাথে কিছু ঘটনা ঘটার পর মনে হয় এর আগে এমন ঘটনা তার সাথে আগে হয়তো কোথাও ঘটেছিল, কিছু কথা কারো মুখে শুনার পর মনে হয় এর আগে কই যেন শুনেছিলো, কিছু মানুষকে দেখলে মনে হয় এর আগে তার সাথে কোথায় যেন দেখা হয়েছিলো অথবা তাকে বেশ চেনা চেনা লাগছে।


কিন্তু বাস্তবে এর আগে এসব কিছু না ঘটলেও কেন তার এমন মনে হয়? একদল সুফি এবং মনোবিজ্ঞানী বলেছে, ‘এমনটা হওয়ার মূল কারণ স্বপ্ন। স্বপ্নে আমরা অনেক কিছুই দেখি কিন্তু  অতিদ্রুত তা ভুলে যাই। অর্থাৎ স্বপ্নে ঘটে যাওয়া ঘটনার স্থায়ীকাল খুবই কম। একারণে যদি বাস্তবে এমন কিছু ঘটে যা মনে হয় এর আগে আমার সাথে হয়তো এমনটা হয়েছিল, তা হলে সেটা হলো চাপা পরা স্মৃতি নাড়া দেয় অর্থাৎ অবচেতন মনের স্বপ্নে দেখা সেই স্মৃতি সিগনাল দিতে থাকে।’


মানুষ তার জীবনের এক তৃতীয়াংশ ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। অর্থাৎ একজন মানুষ যদি ৬০ বছর জীবিত থাকে তাহলে সে ঘুমায় প্রায় ২০ বছর। এই ঘুমের মাঝে আমরা সচেতন বা অবচেতনভাবে যে ঘটনা আমরা দেখতে পাই তাই হলো স্বপ্ন। তবে ঘুমের মাঝে আমাদের সচেতন মনের চেয়ে অবচেতন মনের কাজই বেশি হয়। স্বপ্ন হলো এক প্রকার আমাদের স্মৃতিশক্তি ও চেতনার ফলাফল। যা ঘুমের মাঝে বা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় দেখতে পাই।


একদল মনোবিজ্ঞানী বলেন, ‘স্বপ্ন এক ধরণের হেলিসেনিটরি এক্সপেরিয়েন্স বলা যেতে পারে। স্বপ্ন হলো স্বপ্ন, যার কোনো বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। আমরা এমন সব জিনিস স্বপ্নে দেখি যার অস্তিত্ব পৃথিবীর কোথাও নেই। যেমন কিছু গাছ, কিছু মানুষ বা অন্য অনেক কিছুই আমরা দেখে থাকি। এভাবেও বলা যায় যে আমি যে স্থানে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখি সে স্থানের আশেপাশে স্বপ্নের বস্তুসমূহের অস্তিত্ব বাস্তবে নেই।’ তাই মনোবিজ্ঞানীরা স্বপ্নকে একধরনের হেলিসেনিটরি এক্সপেরিয়েন্স বলে থাকে।


পরিচিত অনেকের সাথে স্বপ্নের এই ব্যাপারগুলি নিয়ে কথা বলেছিলাম। তাদের অনেকেই বললো হ্যা এমনই মনে হয়। কিছু ঘটনা মনে হয় এর আগে এভাবে ঘটেছিল, কিছু কথা মনে এর আগে কোথাও যেন শুনেছি এবং কিছু মানুষকে দেখলে অনেক পরিচিত ও কাছের মনে হয়।


কিছু মানুষকে দেখলে পরিচিত মনে হয় কিন্তু বাস্তবে আদৌ এর আগে সাক্ষাৎ হয়নি। এটা নিয়ে আধ্যাত্মিক চিন্তাবিদরা বলেছেন যে, ‘জন্মের আগে আরেকটা জগৎ ছিল যা রূহের জগৎ নামে পরিচিত। সেই জগতে উক্ত ব্যক্তির আত্মা নিজের আত্মার আশেপাশে হয়তো ছিল বলেই এমন পরিচিত লাগে অথবা মনে হয় সে কত আপন।’


স্বপ্ন নিয়ে অনেক মানুষের সাথে তাদের দেখা স্বপ্ন নিয়ে আলোচনা করার সময় একজন জানালো যে, সে স্বপ্ন একজনকে প্রায় স্বপ্নে দেখতো এবং অদ্ভুত বিষয় হলো পরবর্তিতে বাস্তবে তার সাথে ময়মনসিংহে এক আত্মীয়র বাড়িতে দেখা হয়েছিল। আরেকজন বললো সে প্রায় অদ্ভুত কিছু জায়গায় নিজেকে দেখে। স্থান এবং মানুষ সবই অপরিচিত। সে ব্যক্তির একবন্ধু জানিয়েছিল সে প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখে কিন্তু কি দেখে কিছুই মনে থাকেনা। অন্য আরেকজন বললো, সে সুন্দর অথবা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলে তা ডায়েরিতে নোট করে রাখে।

 

শেষের দিকে একজন বললো, “কয়েকদিন আগে টানা তিনদিন স্বপ্ন দেখেছি এবং তিনদিনের স্বপ্নের অনেক কিছুই আজও অবধি মনে আছে। সাধারণত স্বপ্ন আমার বেশিক্ষণ মনে থাকেনা। অদ্ভুত ব্যাপার  হলো ঐ তিন দিনের স্বপ্নের মানুষগুলি একে অপরের পরিচিত এবং স্বপ্নে এছাড়াও আরো কিছু কমন ব্যাপার ছিল। এর অনেক আগের এক রাতের স্বপ্ন, যে রাতে আমি তিনবার স্বপ্ন দেখি এবং তিনবারই ঘুম ভেংগে যায় স্বপ্ন অসমাপ্ত অবস্থায়। আর তিনটা স্বপ্ন ছিল সিকোয়েন্স টাইপের। একটা স্বপ্নের সমাপ্তি যেখানে হয়েছিল অন্য একটা স্বপ্নের শুরু সেখান থেকে। হয়তো কারো কাছে গাঁজাখুরি মনে হতে পারে। কিন্তু এটাই সত্য।” 


সাইকোলজির একটি অংশ স্বপ্ন। আর স্বপ্ন হলো আপেক্ষিক বিষয়। কারো কাছে বিশ্বাসযোগ্য, আবার কারো কাছে না। স্বপ্নের সাথে টেলিপ্যাথির একটা যোগসূত্র আছে। স্বপ্নে এডভান্স দেখাটা একধরণের টাইম ট্রাভেলেসের মত মনে হয়। স্বপ্ন নিয়ে অনেক মুভি আছে। ইনসেপশন তার ভিতর অন্যতম। অনেক বইও আছে। হুমায়ূন আহমেদের 'মিসির আলি' সিরিজে স্বপ্ন নিয়ে কয়েকটা গল্পও আছে। পড়লে স্বপ্ন নিয়ে কিছুটা আগ্রহ জন্মাবে। তবে 'সোলেমানি খোয়াবনামা' নামক বাজারে কিছু বই পাওয়া যায়। এসব স্বপ্নের বই থেকে যতটুকু সম্ভব দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়। কুরআন-হাদিসের সাথে এসব বইয়ের অনেক বিষয় সাংঘর্ষিক দেখা দেয়। 


কিছু কিছু স্বপ্নে দেখা যায় এক জায়গায় যে টাইমে যাওয়ার কথা সেই টাইম পার হয়ে গেছে কিন্তু আপনি অন্যকোনো কাজে আটকা পড়ে গেছেন বিধায় উক্ত জায়গায় পৌঁছাতে পারেন নি। পরীক্ষা নিয়েও অনেকেই দেখে যে শেষ সময়ে অথবা পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর এসে উপস্থিত হয়েছে। পরীক্ষার মাঝে কলম চলেনা অথবা কি লিখব তা মনে পড়তেছে না এমনও হয়।


স্বপ্নের মাঝে বোবায় ধরা একটা কমন ব্যাপার। অনেকেরই বোবায় ধরার অভিজ্ঞতা আছে। বিজ্ঞান বলে- ঘুমের মাঝে কখনো কখনো মস্তিষ্কের চেতন অংশের পুরোটা একত্রে কার্যকর হয় না। তখন অন্য অনুভবশক্তি সচল থাকলেও ঘুম ভাঙ্গার পর চলন ও বাকশক্তি ফিরতে একটু সময় নেয়। এর মাঝেই তৈরি হয় সাময়িক পক্ষাঘাত বা বোবায় ধরা। এটি ঘুম এবং জাগরণের মাঝামাঝি একটি পর্যায়। 


বোবায় ধরা নিয়ে ইসলামি চিন্তাবিদরা বলেছেন এটি মূলত ঘুমের মাঝে দুষ্টু জ্বীনের কারসাজি। এমনও হয় যে পানির উপর দিয়ে হাটতেছি। আবার নিচ থেকে উপরে উঠতেছি অথবা পিছনে কেউ দৌড়ানি দিচ্ছে, আপনি দৌড়াচ্ছেন, চিল্লাচ্ছেন কিন্তু এগুতে পারতেছেন না এবং কেউ চিল্লানি শুনতেছেনা।


হাই স্কুলে থাকতে সুমনদের বাসায় তার বন্ধু দ্বীনইসলাম মাঝে মাঝে ঘুমাতে আসতো তাদের বাড়িতে আত্মীয়স্বজন আসলে। অথবা সুমনও তাদের বাড়িতে যেত ঘুমাতে। রাতে মাঝে মাঝে সুমনের ঘুম ভেংগে যেত দ্বীনইসলামের ঘুমের মাঝে কথা বলার কারণে। হঠা ঘুমের মাঝে বলে উঠতো 'ঐ সর আমাকে বল লাত্থি মারতে দে, ঐ বল আমার কাছে দে' এইরকম অনেক কিছু। ভার্সিটি এডমিশন কোচিং করার সময় সুমন এবং তার বন্ধুরা মিলে মেসে থাকতো। একবন্ধু মাঝে মাঝে গভীর রাতে উঠে একা একা কথা বলতো এবং দরজা খোলে বাইরে চলে যেতে চাইতো। আবার ছোটবেলায় সুমন রাতের বেলায় দেখতো তার ছোট ভাই ঘুমের মাঝে ঘরের বেড়াতে হাত দিয়ে কি যেন খোঁজতো। সুমনের মনে হতো দরজা অথবা জানালা খোঁজতেছে।


এই ব্যাপারে স্বপ্ন নিয়ে সাইকোলজিক্যাল দার্শনিক সিগমন্ড ফ্রয়েড বলেন- স্বপ্নের মাধ্যমে আমাদের অবচেতন মনই আসলে কথা বলছে আমাদের সঙ্গে। ফ্রয়েডের ধারণা, আমাদের স্বাভাবিক জীবনে যেসব আকাঙ্খা, তাড়না, অনুভূতি, চিন্তা আমরা প্রকাশ করতে পারি না, ঘুমন্ত অবস্থায় স্বপ্নের মাধ্যমে সেসব প্রকাশ পায়।


মানুষ গড় ২৫ বছর ঘুমালে প্রায় ৬/৮ বছর স্বপ্ন দেখে গড়পড়তায়। স্বপ্নে ঘড়ি কিংবা সময় নির্ণায়ক যন্ত্র বা ক্যালেন্ডার বাস্তবের মত দেখায় না। অসুস্থ মানুষ অস্বাভাবিক স্বপ্ন বেশি দেখে এবং স্বপ্নের মাঝেও নিজেকে অসুস্থ অবস্থায় দেখতে পায়। এছাড়াও সুস্থ মানুষও অনেক সময় স্বপ্নে নিজেকে অসুস্থ হিসেবে দেখেতে পায়।



কিছু কিছু স্বপ্ন বাস্তব জীবনের মত মনে হলেও পুরোপুরি কিন্তু বাস্তব না। স্বপ্নে যেসব দৃশ্যপট মানুষ দেখে তার অনেক কিছুই কল্পিত জিনিসের চেয়েও ভিন্ন। স্বপ্নে এমন অনেক কিছুই দেখা যায়, যা বাস্তবে আমরা ভুলেও কল্পনা করিনা বা কল্পনা করতে চাই না। সেসব জিনিসও স্বপ্নে এসে ধরা দেয়। এসব স্বপ্ন অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভীতিকর ধরণের। আর কিছু সংখ্যক যৌন উদ্দীপকের প্রতিচ্ছবি। যেসব মানুষকে নিয়ে আমরা কামনামূলক চিন্তা করতেও পাপবোধ করি। স্বপ্নে দেখা যায় সেসব মানুষের সাথে অন্তরঙ্গ মুহুর্তের ঘটনা।


স্বপ্নে সময় এবং স্থান ডিসটর্টেড বা বিকৃত হয়ে যায়। স্বপ্নে সময় এবং স্থান হুটহাট পাল্টে যায়। দেখা যায় একটি মানুষ ক্লাসে বসে আছে হঠাৎ করে স্বপ্নের স্থান পরিবর্তন হয়ে গেছে এবং সে তার বন্ধুদের সাথে পাহাড়ে, নদী বা সমুদ্রের ধারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একজন মানুষ সকালে এক্সাম দেওয়ার কথা সে ঘড়ি দেখে রওনা দিলো ঠিকই পরক্ষণে সে আবিষ্কার করলো এক্সাম হলে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে এখনই বুঝি রাত হবে। সময় এবং স্থানের ডিসটর্টেড একেকজনের বেলায় একেক রকম ঘটে।


স্বপ্নের ঘটনাগুলি অতিবাস্তব মনে হয়। আমাদের এক্সপেকটেশনের চেয়েও আমরা স্বপ্নে অতিরঞ্জিত জিনিস দেখি। একজন মানুষ সে হয়তো ভার্সিটির স্টুডেন্ট অথবা কোনো কর্পোরেট জগতের কর্মচারী। সে স্বপ্নে দেখতেছে যে বিখ্যাত কোনো নায়িকার সাথে অন্তরঙ্গ মুহুর্তের সময় কাটাচ্ছে। অথবা সে দেখতে পারে যে সে দেশের বড় কোনো নেতাগুছের কিছু হয়ে গিয়েছে। আবার স্বপ্নে এমন কিছুও ঘটে যা সাইন্স ফিকশন মুভির মত।


স্বপ্নের ঘটনা বাস্তবতার চেয়েও বেশি আবেগ জড়িত। স্বপ্নে মানুষ আনন্দ পায়, সুখ পায় আবার ভয়ভীতি এবং দুঃখও পেয়ে থাকে। বাস্তব জীবনে যেসব মানুষ আনন্দ এবং হৈ-হুল্লোড় জীবনযাপন করে ঘুমের মাঝে তাদের অধিকাংশ স্বপ্ন আনন্দের হয়। আর বাস্তবে ডিপ্রেসেড বা বিষন্ন মানুষেরা কষ্টের স্বপ্ন বেশি দেখে। দুশ্চিন্তাগ্রস্থ এবং একাকীত্বে যারা ভোগে তারা ঘুমের মাঝে  দুঃখ এবং ভীতিকর স্বপ্ন বেশি দেখে থাকে। স্বপ্নে আমরা বাস্তব জীবনে যেমন চিত্র দেখি তেমনভাবেই চোখে  দেখি, কানে শুনি এবং অনেক কিছুর গন্ধ টের পাই। এছাড়াও স্বপ্নে আমরা স্পর্শের টের পাই। আমাদের অনুভব হয় বাস্তব জীবনের মতই।

মনোবিজ্ঞানীদের একটি অংশ বলে থাকে যে স্বপ্ন অনেক ক্ষেত্রেই কাল্পনিক। আমরা যা কল্পনা করি তাই স্বপ্নে এসে উপস্থিত হয়। আমরা বাস্তব জীবনে সচেতন মনে অনেক কিছুই কল্পনা করি, আবার পরক্ষণেই তা ভুলে যাই। কিন্তু ঘুমের মাঝে মস্তিষ্কের একটি অংশ অবচেতন মনে অতীতের কোনো কল্পনাকে স্বপ্নে এনে রূপদান করে। যার ফলে বলা যায় যে স্বপ্ন হলো কল্পনার বহিঃপ্রকাশ।

স্বপ্নের একটি অদ্ভুত জিনিস হলো আমরা অনেকক্ষেত্রে মৃত মানুষকে জীবিত দেখে থাকি। আমাদের সাথে কথা বলে দৈনন্দিন জীবনের মত খাওয়া দাওয়া করে ইত্যাদি।  আবার জীবিত মানুষকে আমরা মৃত দেখি। দেখা যায় বাস্তবে যে জীবিত স্বপ্নে তার মৃত লাশ। অথবা এক্সিডেন্ট করে মারা গিয়েছে অথবা কেউ হত্যা করেছে। এমনও দেখা যায় যে যে ব্যক্তি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতেছে সে তার নিজের মৃত লাশ দেখতে পাচ্ছে। এই রকম অনেক অতিপ্রাকৃত ঘটনাগুলো ঘুমের মাঝে স্বপ্নে এসে হাজির হয়।


ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখার সময়কে দুটি অংশে ভাগ করা হয়। একটি অংশকে REM Sleep আরেকটি অংশকে Non-REM Sleep বলা হয়।  রাতের শুরুতে ঘুমের অংশে Non-REM এর উপস্থিতি বেশি দেখা যায়। নন রেম স্লিপের স্বপ্ন আমাদের মনে কম থাকে। আর রেম স্লিপের স্বপ্ন আমাদের বেশি মনে থাকে। REM Sleep হয়ে থাকে রাতের শেষ দিকে। এজন্যই আমাদের শেষ রাতের স্বপ্ন বেশি মনে থাকে। (REM - Rapid Eye Movement)


কোনো কোনো মনোবিজ্ঞানী বলে যে আমরা যখন ঘুমাই তখন আমাদের ব্রেনের বিভিন্ন অংশ এক্টিভ হওয়া শুরু করে যার ফলে সেই অংশগুলি আমাদের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ স্বপ্নের মাধ্যমে উপস্থাপন করে। অনেক মনোবিজ্ঞানী এই মতের সাথে একমত নয়। যারা একমত নন তাদের কিছু সংখ্যক বলেন যে, স্বপ্ন হলো আমাদের মনের ইচ্ছার প্রতিফলন। আমরা আমাদের অবচেতন মনের মধ্যে অনেক ইচ্ছা লুকিয়ে রাখি। পরবর্তীতে ঘুমের মাঝে অবচেতন মন সেসব ইচ্ছা স্বপ্ন আকারে তুলে ধরে।


আবার মনোবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ বলে স্বপ্ন হলো আমাদের বাস্তব জীবনের ঘটনার প্রবাহধারা। আমরা বাস্তব জীবনে যা করি, যা দেখি, যা শুনি সেসবই কিছু কাটছাট অথবা ডালপালা যোগ হয়ে স্বপ্ন আকারে উপস্থিত হয়। যেমন একজন ফুটবল প্লেয়ার সে প্রায় দেখে সে খেলার মাঠে খেলতেছে। স্টুডেন্টরা দেখে পরীক্ষার হলে পরীক্ষা দিচ্ছে। কর্মজীবীরা দেখে তাদের কর্মক্ষেত্রের দৃশ্যপট। ঘুমের মাঝে স্বপ্নে আমরা তাই দেখি যা আমাদের জীবনে দিনের বেলায় ঘটে। অর্থাৎ দৈনন্দিন ঘটনার রিফ্লেক্ট হয় স্বপ্নে। ঘুম এবং স্বপ্ন এক প্রকার স্মৃতিশক্তির সংমিশ্রণ। 


আধুনিক মনোবিজ্ঞানীদের একটি দল গবেষণা করে কিছু থিওরি বের করে যে, স্বপ্ন আমরা কেন দেখি। এসবের ভিতর জনপ্রিয় থিওরি হলো Activation Synthesis Hypothesis। ঘুমের মাঝে আমাদের ব্রেনের যে অংশগুলো ছবি তৈরি করে ঘুমের মাঝে তা সক্রিয় হয়। আমাদের ব্রেনের শেষের দিকে পঞ্জ বলে একটি অংশ আছে, মূলত সেটা সক্রিয় হয়ে উঠে। তার ফলে আমরা টর্চ লাইট বা প্রজেক্টের আলোর মত বিভিন্ন ছবি দেখতে পাই। এই ছবিগুলো যখন আমাদের ব্রেনের লজিক্যাল অংশে যায় তখন সেটা একসাথে সিনথেসিজ বা কমবাইন্ড করে মুভির মত দৃশ্যপট তৈরি করার চেষ্টা করে। ধরেন, আপনি কোনো একটি আর্ট গ্যালারিতে গেলেন চিত্র প্রদর্শনী দেখতে। সেখানে আপনি বিভিন্ন রকম ছবি দেখবেন, একেকটা একেক রকম অর্থাৎ ছবিগুলো থাকে ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু ঘুমের মাঝে স্বপ্নে ব্রেন এই ছবিগুলো একত্রিত করে লজিক্যাল স্থানে পাঠিয়ে দেয়। যার ফলে ছবিগুলো চলমান দৃশ্যপট তৈরি হয়ে এক অদ্ভুত ঘটনার জন্ম দেয়। এজন্য যা হয় তা হলো একটি দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে আপনি খেলার মাঠে খেলছেন, পরক্ষণেই দেখা যায় আপনি বিদেশে বা অচেনা কোনো সুন্দর জায়গা অথবা ভীতিকর জায়গায় আছেন এবং দুটি জায়গায় আপনার বয়সের অনেক তফাৎ। কেমন যেন একটু অগুছালো দৃশ্যপট। ব্যাপারটা টাইম এন্ড স্পেস ডিসটর্টেড হওয়ার মতই।


মৃত্যুর আগে মানুষ কি ধরনের স্বপ্ন দেখে এটি বড় জানার এবং গবেষণার বিষয়। তবে মৃত্যুর আগে মানুষের হৃদয়পটে তার অতীত চিত্র ভেসে উঠে বলে জানা যায়। মৃত্যুর আগে একজন সুস্থ মানুষ প্রচুর পরিমাণে স্বপ্ন দেখে। হয়তো এই স্বপ্ন তার অবচেতন মন তার মৃত্যুর সময়ের সংকেত দিতে থাকে। কেউ অনেকটা বুঝে যায়, আবার কেউ কিছুই বুঝেনা। মৃত্যু এক অনিবার্য সত্য। কিছু কিছু মানুষ স্বপ্নে দেখে তার নিজেরই মৃত্যু হয়েছে। তার লাশের কবরস্থ করার ব্যবস্থা চলতেছে। অথচ স্বপ্নের মাঝে সে কাউকে কিছু বলতে পারছেনা বা বুঝাতে পারছেনা।


বাস্তবে মানুষের অনেক ধরনের ফোবিয়া থাকে। স্বপ্নে ফোবিয়ার কারনে অধিকাংশ মানুষ নিজস্ব সন্দেহজনক ফোবিয়াতে আটকে যায়। ফলে স্বপ্নের মাঝেই ব্যক্তি ভয়ে আতংকে আতকে উঠে। যেমন অনেকের উচ্চতা নিয়ে ফোবিয়া থাকায় তারা দেখে যে তারা উপর থেকে নিচের দিকে পরে যাচ্ছে এবং ভয়ে ভীষণ আতকে উঠে। এছাড়াও যাদের ভূতফোবিয়া আছে  অধিকাংশ সময় তারা ভৌতিক কোনো স্বপ্ন দেখে। সাপ দেখার ব্যাপারটাও সেই রকম। কিন্তু মেয়েরা স্বপ্নে তেলাপোকা দেখে কি না এটা ভীষণ ভাবার বিষয়। অথচ বাস্তবে মেয়েরা তেলাপোকাকে ডাইনোসরের চেয়েও বেশি ভয় পায়।


স্বপ্নে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে অদ্ভুত কিছু চেহারা এবং তাড়িয়ে বেড়ায় আমাদের পিছনে যাতে আমাদের ধরতে পারলে কপোকাত করবে এবং একদম আমাদের জ্যান্ত মেরে ফেলবে। তখন যতই চিৎকার বা শব্দ করিনা কেন স্বপ্নের জগতের কেউই তা দেখেও না এবং কর্ণপাতও করেনা। বাস্তবে স্বপ্ন দেখা ঘুমন্ত ব্যক্তির পাশের জন হয়তো গোঙানির মত শব্দ পেয়ে থাকে। স্বপ্নে আমরা ভয় পেয়ে দৌড়াতে গেলে আমাদের পাগুলো অসাড় হয়ে যায়। দৌড়ে আমরা পালিয়ে বাঁচতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাই, কিন্তু মুক্তি পাই হুট করে ঘুম ভেংগে যাওয়ায়। হয়তো অবচেতন মন আমাদের এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে চায় বলেই আমাদের জাগ্রত করে দেয়।


এই ভয়ংকর স্বপ্নের পিছনে আছে আমাদের বাস্তব জীবনের কিছু ভয়ংকর স্মৃতি ঘটনা, যা স্বপ্নে অবচেতন মন আমাদেরকে বারবার নাড়া দেয়। ছোটবেলায় আমাদের অনেকের মাঝে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে, যা আমাদের সাব-কনশাস মাইন্ডে সেভ হয়ে যায়। তা বাস্তব কোনো কারণে বা স্বপ্নে অন্যকোন রূপে এসে আমাদের অবচেতন মনকে নাড়া দিয়ে তুলে। ফলে আমরা একটি ভয়ংকর স্বপ্নের মুখোমুখি হই এবং ঘুম ভাঙ্গে আচমকা এক উৎকণ্ঠায়। এসব স্বপ্ন মানুষকে করে তোলে ভীত সন্ত্রস্ত এবং আত্মবিশ্বাসহীন। তখন নিজেকে মনে হয় তুচ্ছ কেউ।


মানুষ অনেক বড় ধরণের আইডিয়া স্বপ্নের মাঝে পেয়ে থাকে অর্থাৎ সাব-কনশাস মাইন্ড তাকে সিগনাল দেয় যে এটা তাকে করতে হবে এবং এটা তার দ্বারাই সম্ভব। এই ব্যাপারে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি তাদের সাক্ষাৎকারে তা স্বীকার করেছে।


দেজাভ্যু মূলত ভবিষ্যৎকে স্বপ্নে দেখার মতই একটা জিনিস। অনেক সংখ্যক মানুষ ভবিষ্যতের অনেককিছুই সে স্বপ্নে দেখে। তবে তা হুবুহু না হলেও অনেকটা মিল থাকে। ফলে উক্ত ঘটনা যখন ভবিষ্যতে সংঘটিত হয় তখন ঘটে যাওয়া ব্যক্তি মনে করে এই ঘটনা আগেও আমার সাথে কোথায় যেন ঘটেছিল।


বলা হয়ে থাকে যে যতবেশি স্বপ্ন দেখে এবং মনে রাখতে পারে, সে তত বেশি মেধাবী হয়ে থাকে। তবে সাইকোলজি বলে অনেকেই মেন্টাল ডিজঅর্ডারের কারণে অনবরত স্বপ্ন দেখে। তন্দ্রা, ঘুমন্ত এবং কি জাগ্রত অবস্থাতেও স্বপ্ন দেখে বলে বলা হয়েছে। তবে জাগ্রত অবস্থার স্বপ্ন এক ধরণের চিন্তাকল্পনা বলে দাবি করেছে সাইকোলজির একদল বিশেষজ্ঞ। 


স্বপ্নহীন বলে কোনো ঘুম নেই। কারণ অবচেতন মন সর্বদা জাগ্রত থাকে। তাই প্রতিটি মানুষ ঘুমন্ত অবস্থায় অবশ্যই স্বপ্ন দেখে। তবে কারো মনে থাকে, কারো থাকেনা। একাধিক স্বপ্নের মাঝে মানুষের মূলত দু'একটি স্বপ্ন মনে থাকে। 


স্বপ্নে হোক অথবা বাস্তবে হোক আমাদের জীবনের অধিকাংশ সিদ্ধান্ত আমাদের সাব-কনশাস মাইন্ড নিয়ে থাকে। পরবর্তীতে আমরা অনুধাবন করি যে সিদ্ধান্তটি নেওয়া মনে হয় বরং উচিৎ হয়নি। তবুও পরবর্তীতে মানুষ হিসেবে আমরা এত অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যাওয়ার পরেও সাব-কনশাস মাইন্ড বলুন আর যাই বলুন আমরা অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি।


আমরা স্বপ্নে যেসব মানুষদের দেখি তার ৮০ শতাংশ আমাদের পরিচিত। আর ২০ শতাংশ মানুষ অপরিচিত। তবে সুফিবাদ এবং সাইকোলজি মনে করে ঐ ২০ শতাংশ মানুষও আমাদের পরিচিত। অবচেতন মন তাদের দেখে কিন্তু চেতন মন স্মৃতিলোপের কারণে হয়তো সনাক্ত করতে পারেনা। বলা হয়ে থাকে, ঐ অপরিচিত মানুষরা হয়তো বাস্তবে দু'একবার আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। কিন্তু কনশাস মাইন্ড সেটা ক্যাপচার করতে পারেনি। 


এছাড়াও বলা হয়ে থাক, হয়তো ঐ অপরিচিত কিছু সংখ্যক মানুষদের সাথে আমরা ভবিষ্যতে সাক্ষাৎ পাবো। এসব বিষয় আমাদের সাব-কনশাস মাইন্ডে সেভ থাকে বলে আমরা তৎক্ষনাৎ আমরা সনাক্ত করতে পারিনা। আমাদের স্মৃতিভ্রম বা স্মৃতিভ্রংশ হলেও যাবতীয় সকল স্মৃতি আমাদের সাব-কনশাস মাইন্ডের মেমোরিতে অটোমেটিক সেভ হয়ে থাকে। 


এক ব্যক্তি হযরত আলী (রাঃ) এর কাছে জানতে চাইলেন, ইয়া আলী আমাদের মনে অন্য মানুষ যাকে আমরা কোনদিন চিনতাম না জানতাম তার জন্য কিভাবে এতো ভালোবাসা, মায়া তৈরি হয়? কেন তাকে আমাদের মনে এতো ভালো লাগে ? আলী (রাঃ) বলেন, আল্লাহ তা’আলা দুনিয়া তৈরি করার পূর্বে সকল মানুষের রূহ তৈরি করেন এবং সেই সকল মানুষের রূহ এক জায়গায় একত্রিত করে রেখেছিলেন, সেইখানে যেই রূহ গুলো একজন আরেকজনের বেশি নিকটে ছিলো তারা যখন দুনিয়াতে একে অপরের সামনে আসে তখন তাদের মধ্যে ভালোবাসার জন্ম নেয়। অর্থাৎ দুই রূহের মিলনেই ভালবাসার জন্ম হয়।


মানুষের অধিকাংশ খারাপ ফিল করায়  অসংগতিমূলক খারাপ স্বপ্ন দেখে থাকে। আবার কিছু স্বপ্ন আছে সরল স্বপ্ন, মানে আমরা দৈনন্দিন জীবনে যা করি এই রকম টাইপের। অধিকাংশ স্বপ্ন খারাপ ফিল করালেও কিছু স্বপ্ন আমাদের হ্যাপি ফিল করায়। দিনরাত মিলিয়ে ৭/৮ ঘন্টা ঘুমে মানুষ সবমিলিয়ে গড়ে ২ ঘন্টার মত স্বপ্ন দেখে থাকে। তাই আগেই বলা হয়েছে অধিকাংশ স্বপ্নই মানুষ মনে রাখতে পারেনা।


ঘুমন্ত অবস্থায় যখন আমরা স্বপ্ন দেখি তখন আশেপাশের শব্দ, পরিবেশ এবং তাপমাত্রা এসব অনুযায়ী আমাদের ঘুমের মাঝে স্বপ্নের দৃশ্য পথ তৈরি হয়। দেখা গেল শীতের মাঝে ঘুমন্ত অবস্থায় আমার শরীরের কম্বলটি সরে গেল, তাতে স্বাভাবিকভাবেই আমার শীত লাগা শুরু হবে। কিন্তু সাবকনশাস মাইন্ড আমাকে অন্য একটি জগতে নিয়ে যাবে স্বপ্নের মধ্যে। দেখা যাবে যে আমি কোন বরফ শীতল দেশে অথবা বৃষ্টির মধ্যে ভিজে শীতে কাবু অবস্থায় আছি। তাই আশেপাশের শব্দ, পরিবেশ এবং তাপমাত্রা আমাদের ঘুমের মাঝের স্বপ্নকে নিয়ন্ত্রণ করে বলে ধরে নেওয়া যায়।


স্বপ্নের মাঝে আমরা যেসব জিনিস দেখি তাতে সাবকনশাস মাইন্ড অধিকাংশ সময় আমাদের পছন্দ বা অপছন্দের বিষয়গুলো নির্ধারণ করে দেয়। তাই বাস্তবে যদি হলুদ রঙ আমাদের অপছন্দের হয়, তাহলে দেখা যাবে স্বপ্নের মাঝেও এই হলুদ রং আমাদের অপছন্দ। সাবকনশাস মাইন্ড কখনো মিথ্যা বলে না বা অন্যায় কাজ করেনা। তাই কেউ যদি কনশাসলি মিথ্যা বলে বা অন্যায় কাজ করে তাহলে সাবকনশাস মাইন্ড তাকে মানসিক পীড়া দিয়ে থাকে। নিজেকে বারবার অপরাধী মনে হয়। এমনকি এটা স্বপ্নের মাঝেও ঘটে থাকে।


পরিবেশ পরিস্থিতি এবং সময়ের কারণে আমাদের ব্রেইন স্বপ্নের ঘটনার সাথে কানেক্টেট হয়। তাই ব্রেইন আমাদের যেভাবে কমান্ড দেয় আমরা সেভাবেই রিয়েক্ট করি স্বপ্নের মাঝে। টেলিপ্যাথি এবং স্বপ্ন একটি অপরটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। টেলিপ্যাথি এবং স্বপ্ন আমাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়রই একটি ব্যাপার। স্বপ্ন তত্ত্ব নিয়ে মানব ইতিহাসের সেই প্রাচীনকাল থেকেই গবেষণা করে আসছে ক্যালডীয়, ব্যবলনীয় এবং সুমিয়রাসহ অনেক প্রাচীন সভ্যতার মানুষ। স্বপ্ন নিয়ে বিজ্ঞানীরা নিছক একটি বিষয় উড়িয়ে দিলেও সাইকোলজিস্টরা এ নিয়ে করেছে ব্যাপক গবেষণা। 


বলা হয়ে থাকে ঘুমের মাঝে স্বপ্ন বিক্ষিপ্ত আকারে আমাদের জীবনে ধরা দিলেও স্বপ্ন মোটেও বিক্ষিপ্ত কোনো বিষয় না। স্বপ্ন আসে আমাদের সাব-কনশাস মাইন্ডের মেমোরি সেল থেকে ওঠে আসা কিছু ভিজ্যুয়াল দৃশ্যপট। এই দৃশ্যপট যেমন আমাদের অতীতের ধারণা দেয় বা অতীত ঘটনাকে নাড়া দেয় তেমনি এই স্বপ্ন বুনে দেয় আমাদের ভবিষ্যতের এক রহস্যময় সিঁড়ি। যে সিঁড়ি নিয়ে যায় বিভিন্ন জগৎ থেকে বিভিন্ন জগতে। অথবা সেই সিঁড়ি আমাদের ভিন্ন কোনো দ্যুলোকের ঠিকানায় পৌঁছে দেয়। আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞান এবং মনের সীমাবদ্ধতার কারণে হয়তো সেটি বুঝা বা আবিষ্কার করা সম্ভব হয় না।


ছোটবেলায় কোনো শিশু যদি অশালীন বা অপ্রকৃতস্থ কিছু দেখে ফেলে তাহলে তা সাব-কনশাস মাইন্ডে সেভ হয়ে যায়। যার ফলে কোনো রকম বাস্তব বা স্বপ্নে ঐ রকম বা কাছাকাছির দৃশ্যপট যদি তার স্বপ্নে ভেসে উঠে তাহলে সে ঘুমন্ত অবস্থায় স্বপ্নে অথবা বাস্তব জীবনে ভীষণ রকম ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে।


শিশুদের বুঝ ক্ষমতার আগে শিশুরা ঘুমন্ত অবস্থায় হাসে-কাঁদে এবং মৃদু শব্দ করে ওঠে। মূলত তখন শিশুরা স্বপ্ন দেখে। শিশুরা মজার বা ভালো কিছু দেখলে হেসে ওঠে এবং ভয়ংকর বা খারাপ কিছু দেখলে কেঁদে ওঠে। শিশুদের স্বপ্নে মূলত পরিচিত মুখগুলো ভেসে উঠে। এর ভিতর মা-বাবা ছাড়াও শিশুর যত্ন নেওয়ার জন্য আশেপাশে যেসব মানুষ থাকে তাদের দেখে। অনেক সময় শিশুরা নরম বা আরাম বিছানায় ঘুমালে স্বপ্নে সুখকর স্বপ্ন দেখে বলে মনোবিজ্ঞানীরা বলেছে। এর মূল কারণ হলো আরামদায়ক পজিশনে মানুষ সুন্দর ও আনন্দের স্বপ্ন দেখে এবং কষ্টদায়ক জায়গায় ঘুমালে তার বিপরীত ঘটনাটাই ঘটে অর্থা অসুন্দর এবং ভীতিকর স্বপ্ন দেখে।


শিশুরা মায়ের কোলে চরম প্রশান্তি অনুভব করে, তাই মায়ের কোলে নির্বিঘ্নে ঘুমিয়ে যায়। শিশুর অবচেতন মন বলে এটা সময়চেয়ে সুরক্ষিত জায়গা। তাই দেখা যায় মায়ের কোল থেকে অন্য কারো কোলে নেওয়ার সময় শিশু অস্বস্তিকর অনুভব করে এবং শব্দ করে ওঠে। এর মূল কারণ শিশুর সাব-কনশাস মাইন্ড বিষয়টা টের পেয়ে যায়। এজন্যই শিশুর পরম তৃপ্তির সাথে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে যায় এবং অবচেতন মন সর্বোচ্চ নিরাপদ স্থান মনে করে।


অনেক সময় দেখা যায় শিশুরা রাতে প্রচুর কেঁদে ওঠে। এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখা থাকলেও সাইকোলজি বলে সন্ধ্যা রাতে কিছু অশরীরী আত্মা শিশুর উপর ভর করে অথবা শিশুর চারপাশে ঘুরঘুর করে থাকে। ফলে গভীর রাতে শিশু বাচ্চাদের অশরীরী আত্মা জ্বালাতন করে বলে কান্না করে উঠে। এটি অনেকটা সুফিবাদ বা ধর্মীয় ব্যাখার অধীনে পরে যায়। তবে সাইকোলজি বলে যে শিশুরা স্বপ্নে ভয়ংকর কিছু দেখলে কেঁদে উঠে। 


শিশুরা বোধশক্তি হওয়ার আগে থেকেই স্বপ্ন দেখে। এই স্বপ্নকে শৈশব স্বপ্ন বলা হয়। বড়দের স্বপ্নের বিকৃতি ঘটলেও শিশুদের স্বপ্নের বিকৃতি ঘটেনা। কারণ শিশুদের কনশাস মাইন্ড পুরোপুরি তৈরি হয়না বিধায় সাব-কনশাস মাইন্ড ঘুমের মাঝে স্বপ্ন জগৎ তৈরি করে। সাব-কনশাস মাইন্ড বিকৃতি পছন্দ করেনা বিধায় শিশুদের স্বপ্নের বিকৃতি তেমন ঘটেনা।


তবে সাইকোলজির গবেষণায় দেখা গিয়েছে শিশুদের বয়সের শেষের দিকে অর্থাৎ ৭/৮ বছরের পর থেকে স্বপ্নের বিকৃতি ঘটতে থাকে। তখন শিশুরা বড়দের মত অনেক স্বপ্ন দেখে থাকে ঘুমের মাঝে। আবার অনেকসময় বড়রাও শিশুদের মত শিশুসুলভ স্বপ্ন দেখে। হয়তো শৈশবের স্মৃতির কারণে সাব-কনশাস মাইন্ড বড়দের ঘুমের মাঝে এসব স্বপ্ন তৈরি করে।


নিত্যদিনকার ঘটনাই শিশুরা তার স্বপ্নে দেখে থাকে। শিশুদের স্বপ্ন হলো আগের দিনগুলোর অভিজ্ঞতার প্রতিক্রিয়া। শিশুদের স্বপ্ন হলো সহজ এবং সরল প্রকৃতির। শিশুদের সব স্বপ্নকে অর্থহীন বলা যায় না। স্বপ্নগুলো মূলত সম্পূর্ণ, বোধগম্য এবং মানসিক কর্মকাণ্ডেরই ফল।  


শিশুদের বয়সের শেষের দিকে এবং বড়দের বয়সের শুরু থেকে মৃত্যু অবধি যেসব স্বপ্ন দেখে সেসব স্বপ্নের অনেক স্বপ্নেরই বিকৃতি ঘটে। মানসিক ও শারীরিক উদ্দীপনার ফলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে বিধায় স্বপ্নের বিকৃতি হয়। মানুষের স্বাভাবিক জীবনের চেয়েও ভিন্ন ধরনের স্বপ্ন দেখতে থাকে। 

ছোটবেলায় মানুষের স্বপ্নের একটা আনন্দদায়ক এবং বাস্তবে কষ্টদায়ক ব্যাপার ঘটে থাকে। শিশুকালে মানুষ দেখে কি নির্মল সুন্দর একটা জায়গায় প্রসাব করতেছে, কিন্তু ঘুমের মাঝে বিছানা ভাসিয়ে দিয়ে থাকে। বিছানায় প্রসাব করার ব্যাপারে শিশু বিশেষজ্ঞরা ব্যাখা করেছেন যে, শিশুরা ছোটবেলায় প্রচুর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে এবং ঘুমের মাঝে প্রসাবের চাপ দিলে অবচেতন মন স্বপ্নে তাকে প্রসাব করার জন্য সুন্দর জায়গায় খোঁজে দেয়। এরপর বাকিটা ইতিহাস।



অনেকেরই স্বপ্ন দেখতে দেখতে সারারাত পার হয়ে যায়। ঘুম ভাঙ্গার পর মনে হয় যে ঘুমের মাঝে স্বপ্ন বিষয়টি না আসলে হয়তো ঘুমটা ভালো হতো। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভুল বলে মন্তব্য করেছে মনোবিজ্ঞানীরা। তাদের ভাষ্যমতে, আমরা যেটুকু ভালো ঘুমাই সেটুকু স্বপ্নের জন্যই সম্ভব হয়। আমাদের ভালো ঘুমের জন্য আমরা স্বপ্নের কাছে ঋণী। ঘুমের মাঝে স্বপ্ন জিনিসটা না থাকলে আমাদের ঘুম ঘনঘন ভেংগে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকতো। তবে অনেক সময় সুন্দর ঘুমের মাঝে ভয়ংকর স্বপ্ন দেখার ফলেও হুট করে ঘুম ভেংগে যায়। স্বপ্নের কাজ হচ্ছে ঘুমকে পাহারা দেওয়া অর্থাৎ ঘুমকে রক্ষা করা।


ঘুমের মাঝে স্বপ্ন হলো আমাদের কল্পনার জগতের ইচ্ছাপূরণের একটি উপায়। বাস্তবিকভাবে মানুষ অনেক ইচ্ছাপূরণ করতে পারেনা অর্থাৎ পূরণ করা সম্ভব না। কিন্তু অবচেতন মন ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দ্বারা মানুষের ইচ্ছার দৃশ্যপটের ব্যবস্থা করে ইচ্ছাপূরণ করে দেয়। যেমন ধরা যাক, বিখ্যাত কোনো নায়িকা বা সুন্দরীর দেখা পাওয়া একজন পুরুষের ইচ্ছা হলো, কিন্তু বাস্তবিকভাবে সেটা সম্ভব না। দেখা গেলো হঠাৎ একদিন সে উক্ত নায়িকা বা সুন্দরীকে নিয়ে ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখেছে। এভাবে অনেকের ইচ্ছাপূরণের ব্যাপার ঘটে স্বপ্নের দ্বারা।


ইচ্ছাপূরণের আরেকটি উপায় হলো কল্পনা করা। তবে স্বপ্ন এবং কল্পনা দুটি ভিন্ন জিনিস। স্বপ্ন হল মানুষের অবচেতন মনের একটি প্রক্রিয়া আর কল্পনা হল মানুষের চেতন মনের একটি প্রক্রিয়া। দু’টিরই অবস্থান কোনো ফ্যান্টাসী জগতে হতে পারে, তবে একটিতে সচেতন মনের তাড়নায় ঘটে আর আরেকটিতে অবচেতন মনের তাড়নায় ঘটে। মানুষের মনে যখন ঘুমের ঘোরে কোনো দৃশ্যের অবতাড়না হয় তখন তাকে স্বপ্ন বলে। এটা মানুষ না চাইলেও দেখতে পারে। স্বপ্নকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তবে অনেকাংশেই এটি অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পরে। আর কল্পনা হল মানুষের মনের সেই অবস্থা যেটি মানুষের সম্পূর্ণ জাগ্রত অবস্থায় হয়ে থাকে। এটি মূলত মানুষের চিন্তার জগত। মানুষ চাইলেই কল্পনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং তার মনের ইচ্ছা মতই যেকোনো বিষয়ে কল্পনা করতে পারে।


স্বপ্ন মূলত তৈরি হয় দুটি জিনিস থেকে; একটি শারীরিক উদ্দীপনা এবং আরেকটি মানসিক উদ্দীপনাকে তৃপ্ত করার চেষ্টা থেকে। আমাদের এটা মানতেই হবে যে স্বপ্ন হলো মানসিক এবং শারীরিক উদ্দীপনার প্রক্রিয়া। যেমন মন থেকে আমরা যাকে ঘৃণা করি, দেখা যায় যে স্বপ্নের মাঝেও সে অপছন্দনীয় ব্যক্তি। এটি মূলত মানসিক উদ্দীপনারই ফল। আবার শারীরিক উদ্দীপনার ফলে মানুষের স্বপ্নদোষ ঘটে থাকে।


স্বপ্ন হচ্ছে একধরনের অভাব মেটানোর তৃপ্তিদায়ক উপায়। ইচ্ছাপূরণ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং যৌনকামনার পরিতৃপ্তি ইত্যাদি স্বপ্নের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে, যদি তা বাস্তবে সম্ভব না হয়। স্বপ্ন যে আমাদের অভাব মেটানোর তৃপ্তিদায়ক উপায় তার প্রমাণ মিলে যৌনকামনামূলক স্বপ্নে, যাকে আমরা মূলত বলি স্বপ্নদোষ। অবিবাহিত যুবক পুরুষরা এটা প্রায় দেখে থাকে।


পুরুষদের ভিতর যারা সঙ্গিনী অথবা হস্তমৈথুন দ্বারা যৌনকামনার সাধ মেটাতে পারেনা, তাদের একধরনের যৌনকামনার অভাব বোধ হয়। পরবর্তীতে ঘুমের মাঝে শারীরিক উদ্দীপনার ফলে পুরুষের যৌনকামনা পরিতৃপ্তি ঘটানোর জন্য স্বপ্নে তা পূরণ হওয়ার জন্য ক্ষেত্র তৈরি হয়। যার ফলে অবিবাহিত যুবকরা প্রচুর পরিমাণে নোংরা স্বপ্ন দেখে অর্থাৎ তাদের স্বপ্নদোষ হয়।


স্বপ্নদোষ এবং দুঃস্বপ্ন বিষয় দুটি ভিন্ন জিনিস। স্বপ্নদোষ হলো একজন পুরুষের ঘুমের মধ্যে বীর্যপাতের অভিজ্ঞতা। মানব সন্তান বিশেষত ছেলেরা বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছালে তাদের বীর্যথলিতে বীর্য এবং অন্ডকোষে শুক্রাণু তৈরি হয়। সময়ের সাথে সাথে বীর্য ক্রমাগত বীর্যথলিতে জমা হতে থাকে। বীর্যথলির ধারণক্ষমতা পূর্ণ হওয়ার পর নিদ্রারত অবস্থায় অনিচ্ছাকৃতভাবে বীর্যপথে বীর্যপাত ঘটে দেহে বীর্যের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রিত হয়, একেই স্বপ্নদোষ বলা হয়। স্বপ্নদোষের সময় অনেকে স্বপ্নে অবচেতনভাবে যৌন কর্মকাণ্ডের প্রতিচ্ছবি অবলোকন করেন, তবে উক্ত অনুভূতি ছাড়াও স্বপ্নদোষ সঙ্ঘটিত হয়ে থাকে।


১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী ছেলেদের এবং প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার প্রাথমিক বছরগুলোতে স্বপ্নদোষ খুব সাধারণ। তবে বয়ঃসন্ধিকালের পরে যেকোনো সময় স্বপ্নদোষ হতে পারে। এটার সাথে যৌন উত্তেজক স্বপ্নের সম্পর্ক থাকতে পারে, আবার নাও পারে। আবার পুরুষদের যৌনকামনা উত্থান ছাড়াই স্বপ্নদোষ ঘটতে পারে। ঘুম থেকে জাগার সময় কিংবা সাধারণত ঘুমের মধ্যে যে স্বপ্নদোষ হয়, তাকে কখনো কখনো ‘সেক্স ড্রিম’ বলা হয়ে থাকে।


দুঃস্বপ্ন বা খারাপ স্বপ্ন হলো অপ্রীতিকর স্বপ্ন যা মনে ভীতি, উদ্বেগ বা চরম দুঃখের মত প্রবল সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। যদিও, মনোবিজ্ঞানের নামকরণ অনুযায়ী দুঃস্বপ্ন ও খারাপ স্বপ্নের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, খারাপ স্বপ্ন দেখার সময় লোকেরা ঘুমন্ত থাকলেও দুঃস্বপ্ন তাদের জাগিয়ে দিতে পারে। স্বপ্নে অস্বস্তি, মানসিক বা শারীরিক ভীতি বা আতঙ্ক সৃষ্টিকারী পরিস্থিতি থাকতে পারে। দুঃস্বপ্নের পরে একজন ব্যক্তি প্রায়শই সঙ্কটপন্ন অবস্থায় জাগ্রত হন এবং কিছু সময়ের জন্য ঘুমাতে অকার্যকর হন।


দুঃস্বপ্নের শারীরিক কারণ হতে পারে অস্বস্তিকর অবস্থায় ঘুমানো বা জ্বর থাকা আর মানসিক কারণ মানসিক চাপ বা উদ্বেগ। দুঃস্বপ্নের একটি সম্ভাব্য উদ্দীপক হতে পারে ঘুমোতে যাওয়ার আগে বেশি পরিমাণের খাবার খাওয়া, যা দেহের বিপাক এবং মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপকে বাড়িয়ে দেয়।


স্বপ্ন মূলত আসে ঘুমের আরইএম (REM) স্তরে, আর দুঃস্বপ্নের আগমন ঘটে এ স্তরের শেষ দিকটায়। দুঃস্বপ্নের জন্ম কোনো অবাস্তব বা অলীক জগতে নয়, এ আমাদের বাস্তব জীবনের বিভিন্ন ঘটনার মিশেলে সৃষ্টি হওয়া বিকৃত এক রূপ। বেশির ভাগ দুঃস্বপ্নের পর কোনো দৃশ্য বা ঘটনা প্রবল হয়ে ধরা দেয়, তাই সত্যি-মিথ্যার পার্থক্য ঠাহর করে উঠতে সময় লাগে।


বড়দের চেয়ে ছোটরাই দুঃস্বপ্ন বেশি দেখে। একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মোটামুটি তিন থেকে ছয় বছর বয়সের মধ্যে দুঃস্বপ্নের আনাগোনা শুরু হয়ে যায় এবং ১০ বছর বয়সের পর তা কমতে শুরু করে। ছোটদের দুঃস্বপ্ন বেশি দেখার কারণ হতে পারে তাদের কাল্পনিক জগতে মুহুর্মুহু বিচরণ। সময়টা যখন জ্বীন-ভূত আর দৈত্য-দানব নিয়ে ভেবেই কাটে, ঘুমেও যে তারা হানা দেবে, এ তেমন আশ্চর্যের কিছু নয়।


দুঃস্বপ্ন আপনার কাছে প্রবল বাস্তব ও ভয়াবহ মনে হবে। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আপনি জেগে উঠতে চাইবেন, কিন্তু পারবেন না যদি না বাহ্যিক কোনো সংস্পর্শে আসেন। দুঃস্বপ্ন একটা সময় পর আপনাকে জাগিয়ে দেবে। অনেক ঘাম হবে ও হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাবে। জাগার পর আপনি পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে বাধাগ্রস্থ হবেন এবং দুঃস্বপ্নে কী দেখেছেন, তা নিয়ে বারবার ভাবনা চলে আসবে। দুঃস্বপ্নের ধরণ বা বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে আপনার পরবর্তী মানসিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। সেটা রাগ, গভীর দুঃখ, বিরক্তি, ঈর্ষা-নেতিবাচক যেকোনো অনুভূতিই হতে পারে। দুঃস্বপ্নকে একটা সীমা পর্যন্ত স্বাভাবিকই ধরা যেতে পারে, কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে গেলে তাকে মানসিক সমস্যার ঘরানায় ফেলা যায়।


স্বপ্ন যে সাদা কালো হয় সে ব্যাখা ভুল। কারণ গবেষণায় দেখা গিয়েছে অধিকাংশ মানুষ কালারফুল স্বপ্ন দেখে। তাই স্বপ্নে আমার রক্তের রঙ কিন্তু লাল দেখতে পাই। আধোঘুম বা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় থাকায় দেখা স্বপ্নগুলো মানুষের মনে বেশিক্ষণ এবং ডিটেইলস মনে থাকে।


অন্ধ এবং জন্মান্ধ না এমন মানুষদের স্বপ্ন অনেকটাই ভিন্ন। জন্মান্ধ না অর্থাৎ কোনো কারণে পরবর্তীকালে অন্ধ হয়ে গিয়েছে তারা স্বাভাবিক মানুষদের মতই স্বপ্ন দেখে। জন্মান্ধরা স্বপ্ন তেমন কিছু দেখেনা বললেই চলে, তবে স্বপ্নে একধরনের আলাদা অনুভব করে।


অন্ধরা খাবার দেখতে পায় না, কিন্তু খাবারের স্বাদ পায়, গন্ধ পায়। এছাড়াও তারা অনেক কিছু শুনতে পায় স্বপ্নের মাঝে। অন্ধরা দৃশ্যমান কোনো স্বপ্ন দেখেনা, কারণ তাদের এই চোখ দিয়ে দেখার দর্শন ইন্দ্রিয় অচল। কিন্তু অন্য সব ইন্দ্রিয় যেহেতু সচল তাই স্বপ্নে তারা ঐসব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যমূলক স্বপ্ন দেখে থাকে।


স্বাভাবিক মানুষের যেখানে দুঃস্বপ্ন দেখার হার ৬ শতাংশ, সেখানে অন্ধ মানুষের দুঃস্বপ্নের পরিমাণ ২৫ শতাংশ।  অন্ধ ব্যক্তিরা তারা হুচুট খেয়ে পরে গিয়ে আঘাত পেয়েছে অথবা গাড়ির নিচে পরে গিয়েছে, ম্যানহোল অথব গর্তে পরে গিয়েছে কিংবা একদল মানুষ হয়তো তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে এমন অনুভবমূলক স্বপ্ন দেখে। 


অন্ধদের অধিকাংশ স্বপ্নই দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে থাকে। সাধারণ মানুষের তুলনায় অন্ধ মানুষেরা স্বপ্নে অনেক বেশি ঝুকিপূর্ণ বা বিপদজনক অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যায়।


নারী পুরুষদের স্বপ্নের ধরণ আলাদা হয়ে থাকে, কারণ নারী পুরুষের চিন্তাগত অনেক পার্থক্য রয়েছে। পুরুষদের স্বপ্ন লিঙ্গভিত্তিক হয়ে থাকে কিন্তু নারীদের স্বপ্ন সর্বজনীন। তবে নারী পুরুষ উভয় কামনাবাসনামূলক স্বপ্ন দেখে থাকে।


সাইকোলজি বলে থাকে যে পশুরাও স্বপ্ন দেখে। পশুদের স্বপ্ন তাদের নিজস্ব জগতের মত করে দেখে। কারণ পশু ঘুমের মাঝে মানুষের মত অনেকটা উদ্ভট আচরণ করে থাকে। তবে পশুদের নিয়ে সাইকোলজি স্বপ্ন বিষয়ে তেমন বেশি ফলাফল পায়নি। কারণ পশুরা তো স্বপ্ন প্রকাশ করতে পারেনা। হয়তো আধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে জানা যাবে পশুদের স্বপ্নসমূহ। 


কিছু স্বপ্ন এই রকম যে, ঘটনাপ্রবাহকে নিজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এটি সাইকোলজির ভাষায় লুসিড ড্রিম বলে, কনশাস মাইন্ড জাগ্রত থাকে ফলে স্বপ্নকে নিজের মত নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কেউ উপর থেকে নিচে পরে যাচ্ছে কিন্তু সে ভাবলো সে নরম কোনো তুলার উপর অথবা পানিতে যেন পরে। পরে দেখা গেলো তার ইচ্চামতই স্বপ্নের মোড় ঘুরে যাচ্ছে।


সাধারণ মানুষ বলে স্বপ্ন দ্বারা আমরা নিয়ন্ত্রিত। স্বপ্নকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা। বরং স্বপ্নই আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে। যার ফলে ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখে আমরা হেসে উঠি, কেঁদে উঠি কিংবা ভয় পাই। কিন্তু আধুনিক মনোবিজ্ঞানীরা বলেন যে, চাইলে আমরা স্বপ্নকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। আর এই থিওরিকে বলা হয় লুসিড ড্রিম। 

ভয়ের স্বপ্ন দেখে আমরা ভয় পাই, কষ্টের স্বপ্ন দেখে আমরা কান্না করি। আর এই রেশ থেকে যায় ঘুম থেকে উঠার পর সারাটা দিন। এমন কি কয়েকদিন পর্যন্ত। কিন্তু স্বপ্ন নিয়ন্ত্রণ করে যদি স্বপ্নের সমাপ্তি আনন্দ দিয়ে শেষ করা যায় তাহলে ঘুম থেকে উঠার পর আমাদের আনন্দ অনুভব হবে। আপনি যদি আপনার স্বপ্ন আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তাহলে আপনার স্বপ্ন হয়ে উঠবে এন্টারটেইনমেন্টের আলাদা একটা জগৎ। আপনি স্বপ্নে মজা করতে পারবেন, বাস্তবে যা কামনা করে পান না, তা আপনি স্বপ্নের মাঝে পূরণ করে নিতে পারবেন। তখন স্বপ্ন আপনার নিকট হয়ে উঠবে অতি বাস্তব। 

এই স্বপ্ন নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আপনাকে প্রথমে স্বপ্নের মাঝেই বুঝতে হবে যে আপনি স্বপ্ন দেখতেছেন। এরপর কিভাবে স্বপ্নকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেটাই হলো মূল বিষয়। এজন্য বাস্তবেই আপনাকে কিছু প্র‍্যাক্টিস প্রতিনিয়ত করে যেতে হবে। তাতে ফলাফল পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক। কারণ ড্রিম ল্যাবে রিসার্চ করে মনোবিশারদরা তাই পেয়েছেন। 

আপনি জেগে আছেন। আসলেই কি আপনি জেগে আছেন! আপনি বাস্তব জগতের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যাচ্ছেন। আসলেই কি আপনি বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যাচ্ছেন! আসলেই কি আপনি জেগে আছেন বা বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যাচ্ছেন কি না এটা আপনি বুঝতে পারেন আশেপাশের পরিবেশ দেখে, সময় এবং স্থান দেখে। বাস্তব জীবনে হুট করে সময় এবং স্থান ডিসটর্টেড বা বিকৃত হয় না। তাই আপনি সহজে বুঝতে পারেন যে আপনি বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যাচ্ছেন এবং জেগে আছেন। ঠিক একই ভাবে আপনি যদি স্বপ্নের মাঝে আপনার পরিবেশ বুঝতে পারেন তাহলে আপনি বুঝে যাবেন যে আপনি বাস্তবে নেই, আপনি আছেন স্বপ্নের জগতে। যখনই আপনি এটা বুঝা শুরু করবেন তখন থেকেই মূলত আপনি স্বপ্ন নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল প্রয়োগ করতে পারবেন। আর তখনই আপনার স্বপ্ন হয়ে উঠবে লুসিড ড্রিম। 

এই লুসিড ড্রিমে প্রবেশ করতে হলে আপনাকে তিনটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে বা বাস্তবে প্র‍্যাক্টিস করতে হবে। যদি আপনি চেষ্টা করেন তাহলে হয়তো আপনি আপনার স্বপ্ন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন এবং আপনার স্বপ্ন হয়ে উঠবে লুসিড ড্রিম।

১। রিয়েলিটি টেস্ট করা অর্থাৎ বাস্তবে আমরা বই পড়ি, আয়নায় নিজেকে দেখি, ফ্যান-লাইটের সুইচ দেই এবং হাতের বা মোবাইলের ঘড়িতে টাইম দেখি। কিন্তু স্বপ্নে আপনি এগুলো ডিসটর্টেড বা বিকৃত দেখবেন। আপনি স্বপ্নে বই পড়তে চাইলে ঠিকমত পড়তে পারবেন না, আয়নায় নিজেকে ক্লিয়ার দেখবেন না, সুইচে টিপ দিতে গেলে সব ওলটপালট দেখাবে এমনকি ঘড়ির টাইম আপনি সঠিক পাবেন না। স্বপ্নে দেখবেন বিকেলের মত কিন্তু ঘড়িতে টাইম দেখাবে সকালের বা রাতের। মিনিটের সংখ্যা ঠিক থাকবে না। তাই এইগুলো আপনি বাস্তবে কিছুদিন ফলো করবেন। সচেতন মনে আপনি বই পড়বেন এবং ভাববেন যে আপনি বাস্তবে বই পড়ছেন, আপনি ঘড়ি দেখার সময় ভাববেন আপনি বাস্তবের ঘড়ি দেখতেছেন, স্বপ্নের মাঝে না। এছাড়াও প্রতিদিন কয়েকবার এক হাতের তালুতে আরেক হাতের আংগুল দিয়ে স্পর্শ করবেন। তালু ফুটু হয়ে আপনার আংগুল বের হয়ে যাবেনা। কিন্তু স্বপ্নে ঘটবে ব্যতিক্রম। দেখা যাবে তালু ভেদ করে আংগুল বের হয়ে গিয়েছে, ঘড়ির টাইম এলোমেলো, বইয়ের লেখা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। তখনই আপনি ঘুমের মাঝে স্বপ্নে হয়তো নিজেকে আবিষ্কার করে ফেলতে পারবেন যে, আপনি স্বপ্ন দেখছেন এবং স্বপ্ন আপনি নিয়ন্ত্রণ করে লুসিড ড্রিমে প্রবেশ করতে পারবেন।

২। আপনি নিজেকে অটো সাজেশন দিবেন। আপনত,নিজেকে বলবেন আপনি ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখবেন।  এভাবে মনে মনে চিন্তা করলে দেখা যাবে আপনি ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখতেছেন এবং বুঝতে পারতেছেন যে আপনি স্বপ্ন দেখতেছেন। আর যখন বুঝতে পারবেন তখনই আপনি নিজের মত করে স্বপ্ন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। 

৩। যেটা আপনি স্বপ্নে দেখতে চান তা নিয়ে আপনি চিন্তা করুন। ঘুমানোর আগে চিন্তা করতে থাকুন বারবার। ধীরে ধীরে তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব চলে আসবে এবং আপনার চোখে ভেসে উঠবে আবছায়া কিছু ছবি। আপনি ছবিগুলো দেখতে থাকুন, তখনই আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে যাবেন না। তাহলে আপনার ঘুম ভেংগে যাবে। আপনি এভাবে চেষ্টা কিছুদিন চালিয়ে যান। তারপর দেখতে পারবেন আপনি গভীর ঘুমের মাঝে স্বপ্নের ভিতরে ঢুকে গিয়েছেন এবং বুঝতে পারতেছেন আপনি স্বপ্নের জগতে আছেন। এরপর আপনি চাইলে আপনার ইচ্ছামত স্বপ্নকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। আপনার স্বপ্ন হয়ে উঠবে লুসিড ড্রিম হিসেবে।


বিশ্বের অনেক মহান মানুষ তার বিখ্যাত সব আইডিয়া পেয়েছেন স্বপ্নের মাঝে। বিভিন্ন নবী রাসুল এবং অন্যান্য ধর্মের প্রবর্তকরা স্বপ্নের মাঝে দিকনির্দেশনা পেতেন। বিখ্যাত রুশ বিজ্ঞানী দিমিত্রি মেন্ডেলিফ পর্যায় সারণীর আইডিয়া পেয়ে থাকেন স্বপ্নের মাঝে। এছাড়াও আলভা এডিসনের একটা চেয়ার ছিল যেখানে তিনি ঘুমাতেন এবং স্বপ্ন দেখতেন। স্বপ্নের মাঝে তিনি বিভিন্ন আইডিয়া পেতেন। স্বপ্নে আইডিয়া পাওয়া নতুন কিছুনা। 


বিজ্ঞান আমাদের বলে যে মানুষের ব্রেন দুভাগে বিভক্ত। একটি লজিক্যাল ব্রেন আরেকটি ইমোশনাল ব্রেন। মানুষ যখন জেগে থাকে তখন লজিক্যাল ব্রেনের অংশ বেশি এক্টিভ থাকে আর যখন মানুষ ঘুমে থাকে তখন ইমোশনাল ব্রেন বেশি এক্টিভ থাকে। মানুষের ঘুমের মাঝে REM হয় শেষ রাতে। এই সময় ইমোশনাল ব্রেন বেশি কাজ করে। আর তখন মানুষের সুপ্ত চিন্তাধারা স্বপ্ন আকারে দেখা দেয়। এটি মনে রাখতে পারলে ঘুম থেকে উঠার পর সেই স্বপ্ন থেকে নতুন নতুন আইডিয়া বা সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে।

আপনি যেসব বিষয়ের উপর আইডিয়া পেতে চান বা যেসব সমস্যার সমাধান পেতে চান তা আপনার ঘুমানোর বিছানার পাশে রাখা ছোট নোট পেডে লিখে রাখুন। যেসব বিষয় নিয়ে আইডিয়া পেতে চান বা যে সমস্যার সমাধান চান তা নিয়ে ঘুমানোর আগে চিন্তা করতে থাকুন। ঘুমের মাঝে দেখা যাবে সেসব বিষয়ের উপর স্বপ্ন তৈরি হচ্ছে। আর যেসব বিষয় নিয়ে আপনি চিন্তা করেছেন বা যেসব সমস্যার সমাধান পেতে চেয়েছেন আপনার ইমোশনাল ব্রেন সেসব বিষয়ের সহজ আইডিয়া তৈরি করে দিবে এবং সমস্যার সমাধান দিবে। 

আপনার ঘুম ভাঙ্গার পর স্বপ্ন মনে রাখার টেকনিক প্রয়োগ করবেন। আপনার বিছানার পাশে রাখা 'ড্রিম ডায়েরি' তে আপনি স্বপ্নগুলো গুছিয়ে লিখুন এবং নতুন নতুন আইডিয়া খুজে বের করুন, পাশাপাশি সমস্যার সমাধান। 


এখন আসি স্বপ্ন কি আসলেই সত্যি হয়! হ্যা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে স্বপ্ন সত্যি হয়। মূলত আল্লাহর পক্ষ থেকে যে স্বপ্ন দেখানো হয় তা সত্যি হয়। তবে হুবহু একই রকম হবে তা না। স্বপ্ন মূলত ইঙ্গিতময় হয়ে থাকে। যেমন; ইউসুফ (আঃ) ছোট সময় একদিন স্বপ্নে দেখলেন যে, এগারোটি নক্ষত্র, সূর্য ও চন্দ্র তার প্রতি অবনত অবস্থায় রয়েছে। পরের দিন ইউসুফ (আ:) তার পিতাকে তার এই স্বপ্নের কথা বললেন। তার পিতা বলেন যে, এগারোটি নক্ষত্রের অর্থ হচ্ছে ইউসুফ (আঃ) এর এগারো ভাই, সূর্যের অর্থ পিতা এবং চন্দ্রের অর্থ মাতা। তিনি স্বপ্নের বর্ণনা শুনে বুঝতে পারলেন এবং ভাইদের কাছে তার এই স্বপ্ন বৃত্তান্ত বর্ণনা না করার জন্য ইউসুফ (আঃ) কে তার পিতা বললেন। কারণ, স্বপ্নের তাৎপর্য অনুধাবন করে ভাইয়েরা ইউসুফ (আঃ) এর প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে তার ক্ষতি করতে পারে।


এরপর ইউসুফ (আঃ) অন্যান্য ঘটনা তো জানা আছে সবাইর। যুবক বয়সে ইউসুফ (আঃ) এর কাছে বাদশাহ তার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন যে - 'আমি সাতটি মোটাতাজা গাভী দেখলাম। এগুলোকেই অন্য সাতটি শীর্ণ গাভী খেয়ে যাচ্ছে। এবং আরও দেখলাম সাতটি গমের সবুজ শীষ ও সাতটি শুষ্ক শীষ।'


ইউসুফ (আঃ) ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, 'সাত বছর ভালো ফলন হবে, এরপর সাত বছর দুর্ভিক্ষ হবে। দুর্ভিক্ষের বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলে এক বছর খুব বৃষ্টিপাত হবে এবং প্রচুর ফসল উৎপন্ন হবে।'


প্রতিটি ধর্মেই স্বপ্নের কথা বলা আছে। ইসলাম ধর্মে ৩ ধরণের স্বপ্নের কথা বলা হয়েছে। 

১। আল্লাহর পক্ষ থেকে,

২। মানুষের মনের চিন্তা-ভাবনা থেকে এবং 

৩। শয়তানের পক্ষ থেকে ভীতি প্রদর্শনমূলক কিছু।


স্বপ্নের ব্যাখ্যা করাটা একটি কঠিন বিষয়। চলমান পরিস্থিতি নিয়ে কেউ যখন খুব চিন্তিত থাকে তখন কল্পনাপ্রসূত মানুষ পরিস্থিতি নিয়ে নানা রকম স্বপ্ন দেখে। এখন এটা নিজের মত করে ব্যাখ্যা করা ঠিক না। মূলত একজন মানুষের বুঝা উচিৎ কোনটা আল্লাহর পক্ষ থেকে আর কোনটি কল্পনা প্রসূত কিংবা শয়তানের পক্ষ থেকে ধোকা।


স্বপ্ন হলো পৃথিবীর বিষ্ময়কর ব্যাপার। স্বপ্নে মানুষ অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। প্রতিটি ধর্মে স্বপ্ন এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইসলাম ধর্মে বিভিন্ন নবী রাসুলগণ এবং অন্যান্য ধর্মের প্রবক্ততারা ধর্মকে এক বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তারা স্বপ্নের ব্যাখা দিতেন। সে অনুযায়ী ব্যাখা মিলেও যেত।

বর্তমানে আমরা স্বপ্নের ব্যাখা বাজারে কথিত বই খোয়াবনামা থেকে বের করার চেষ্টা করি। খোয়াবনামায় একটি বড় ভুল হলো একই স্বপ্নের ব্যাখা জনসাধারণ সবাইর জন্য একই অর্থ দেওয়া। মানে স্বপ্নে সাপ দেখলে সামনে বিপদ, উপর থেকে পড়ে যাওয়া দেখলে চাকরি চলে যাওয়া ইত্যাদি। এখন যে ব্যক্তি চাকরি করেনা সে যদি উপর থেকে পড়ে যাওয়া দেখে তাহলে তার স্বপ্নের প্রকৃত অর্থ কী? মূলত এভাবে খোয়াবনামার জেনারেল ব্যাখা সবাইর জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। তাই বাজারের কথিত খোয়াবনামা বই থেকে স্বপ্নের ব্যাখা বের করা মানে জল বিহীন পুকুরে বড়শী দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করারই নামান্তর। 


স্বপ্নের মানে বা অর্থ বের করতে হবে আপনার নিজেকেই। স্বপ্ন বিশারদ কারো থেকে স্বপ্নের ব্যাখা নেওয়া যেতে পারে৷ কিন্তু সেটা কতটা ফলপ্রসূ হবে তা বলাই বাহুল্য। ধরেন আপনি আর্ট গ্যালারিতে ঘুরতে গেলেন সেখানে নানান ধরণের আর্ট দেখতে পেলেন। এখন একজন আর্ট বিশেষজ্ঞকে বললেন যে এই আর্ট দিয়ে কি বুঝানো হয়েছে, সে তার দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখা করে যাবে। কিন্তু একটি আর্টের মূল অর্থ ঐ আর্টের আর্টিস্ট ভালো জানেন। এছাড়াও ধরেন কবিতার কথা। একটি কবিতা দশজন পড়লো এবং দশজন দশ ধরণের অর্থ তৈরি করবে। তবে প্রকৃত অর্থ কিন্তু যে কবিতাটা লিখেছে সেই ভালো জানে। তাই যে স্বপ্ন দেখেছে সেই সহজে বের করতে পারবে তার স্বপ্নের ব্যাখা।


স্বপ্নের মানে বের করতে হলে অবশ্যই স্বপ্ন মনে থাকতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে স্বপ্নের ঘটনা মনে থাকলে স্বপ্নের মানে বের করা কঠিন। স্বপ্ন মনে রাখার তিনটি কৌশল আপনি নিজের জীবনে প্রয়োগ করলে সহজে স্বপ্ন মনে রাখতে পারবেন এবং পরবর্তীতে স্বপ্নের ব্যাখা দাড় করাতে পারবেন।

১। অটো এলার্ম অর্থাৎ মোবাইল বা কোনো ডিভাইসে এলার্ম না দিয়ে যেমন আমরা ঘুমানোর আগে মনে মনে বলি যে আগামীকাল সকাল ৮ টায় আমাকে উঠতে হবে। পরেরদিন সকালে দেখা যায় ঠিক ৮টার আগেই ঘুম ভেংগে যায়। ঠিক এভাবেই নিজেই নিজের এলার্ম সেট করতে হবে যে আমি আজ স্বপ্ন মনে রাখবো। এভাবে দৃঢ়তার সাথে যদি আপনি মনে মনে স্বপ্ন মনে রাখার জন্য মনকে বলেন তাহলে দেখা যাবে ঘুম ভাঙ্গার পর রাতের স্বপ্ন আপনার মনে পড়তেছে।

২। ঘুম ভাঙ্গার পর চোখ বন্ধ রাখতে হবে। কোনো অবস্থাতেই চোখ না খোলে রাতের দেখা অথবা ঘুমের মাঝে দেখা স্বপ্নের প্লট মনে করার চেষ্টা করা। আপনি স্বপ্নের যে অংশটুকু প্রথমে মনে পড়বে তার আগে কি ঘটেছিল এবং তার আগে কি ঘটেছিল এভাবে তারপরে কি ঘটেছিল এবং তারপর আর কি কি ঘটেছিল এভাবে স্বপ্নের প্লট মনে করার চেষ্টা করলে দেখা যাবে আপনি স্বপ্ন মনে রাখতে পারতেছেন।

৩। আপনি স্বপ্ন মনে করার পর সেটি যদি দীর্ঘস্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করতে চান তাহলে অবশ্যই আপনার ঘুমানোর বিছানার পাশে একটি 'স্বপ্ন ডায়েরি' রাখবেন। যেখানে আপনি স্বপ্নের ঘটনার খুটিনাটি সব লিপিবদ্ধ করে রাখবেন। এভাবে যদি আপনি স্বপ্ন মনে রাখতে পারেন তাহলে আপনার জন্য স্বপ্নের ব্যাখা পেয়ে যাওয়া সহজ হবে।


স্বপ্নের ব্যাখা পেতে হলে অবশ্যই আপনাকে স্বপ্নকে বিশ্লেষণ করতে। এজন্য বাস্তবতা এবং স্বপ্নের ঘটনার সাথে আপনার নিজেকে রিলেট করতে হবে।  আপনি একটি 'স্বপ্ন ডায়েরি'তে আপনার স্বপ্নকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারেন। 


প্রথমে আপনি স্বপ্নের প্লট লিখবেন। সেখানে লিখবেন স্বপ্ন কী দিয়ে শুরু হয়েছিল এবং কী ঘটনা নিয়ে। মাঝখানে কী কী ঘটেছিল এবং স্বপ্নের শেষে কী হয়েছিল। স্বপ্ন শেষ কিভাবে হয়েছিল। কোনো শব্দে ঘুম ভেংগে যাওয় স্বপ্ন শেষ হয়েছিল নাকি এমনিতেই ন্যাচারালি ঘুম ভেংগে গিয়ে স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটেছিল! অথবা ঘুম ভাঙ্গেনি কিন্তু ঘুমের মাঝে এমনিতেই স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটেছিল ইত্যাদি তথ্য সুন্দর করে সাজিয়ে 'স্বপ্ন ডায়েরি' তে তুলে ধরতে হবে। 

স্বপ্নের স্থান উল্লেখ করতে হবে। স্বপ্নে আপনি কোন কোন স্থান দেখেছেন। স্বপ্নের স্থান কি আপনার পরিচিত নাকি অপরিচিত তা উল্লেখ করতে হবে। এছাড়া এটিও অনেক গুরুত্বপূর্ণ যে আপনি কোন স্থানে শুয়ে স্বপ্ন দেখেছেন। নরম বিছানায় নাকি বাসের সিটে নাকি হাসপাতালের বেডে অথবা জেলখানায় শুয়ে। স্বপ্নে স্থানের গুরুত্বও অনেক বেশি।


সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো স্বপ্নে দেখা চরিত্রগুলো লিপিবদ্ধ করা। স্বপ্নে মোট কতজন মানুষকে দেখেছেন। কোন ঘটনার কে পরিচিত এবং কে অপরিচিত তা নিশ্চিত করতে হবে। অপরিচিত মানুষদের সাথে আপনার কী কী ঘটনা ঘটেছে এবং পরিচিত মানুষদের সাথে কী কী ঘটনা ঘটেছে তা উল্লেখ করতে হবে। এছাড়াও পরিচিত যেসব মানুষ স্বপ্নে হাজির হয় তাদের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন। আত্মীয়তার সম্পর্ক, বন্ধুবান্ধব নাকি পাড়াপ্রতিবেশি। তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক কার সাথে এবং খারাপ সম্পর্ক কার সাথে তা উল্লেখ করতে হবে বিশদভাবে। 


স্বপ্ন আপনি কিভাবে দেখেন অর্থাৎ স্বপ্নে আপনার ভূমিকা কী তা লিখতে হবে। আপনি কি স্বপ্নে অন্য মানুষদের কার্যকলাপ দেখেন, যেখানে আপনার কোনো উপস্থিতি নেই। যেমন; আমরা মুভি দেখে থাকি সেরকম নাকি আপনিও স্বপ্নের ভিতরে একজন চরিত্র। আপনিও স্বপ্নে উপস্থিত আছেন এবং আপনাকে কেন্দ্র করে স্বপ্ন এগুচ্ছে নাকি অন্য কাউকে কেন্দ্র করে ইত্যাদি উল্লেখ করতে হবে।


স্বপ্নের মধ্যে কী ধরণের আবেগ বিদ্যমান ছিল তা লিখতে হবে। স্বপ্ন কি আনন্দ, রাগ, দুঃখ, ভয়, কনফিউশান নাকি নিউট্রাল ছিল। এটির ভিতরে যেগুলো বিদ্যমান ছিল সেগুলো উল্লেখ করতে হবে। অনেক সময় আমাদের স্বপ্ন আনন্দ দিয়ে শুরু হয় এবং শেষ হয় দুঃখ দিয়ে। ঘুম ভাঙ্গার পর দেখা যায় চোখে পানি পড়ার চিহ্ন অথবা বুক ধরফরানি। 


আপনি স্বপ্ন লিপিবদ্ধ করতে পারলে এখন আপনার জন্য সহজ হবে স্বপ্নের মানে নিজে থেকে বের করা।

১৷ রিসেন্ট আপনি কী নিয়ে বেশি চিন্তা করছেন এবং কী কী কাজ নিয়ে ব্যস্ততা পার করেছেন বা করতেছেন। স্বপ্নের ঘটনার সাথে আপনার জীবনের কী সম্পর্ক। অধিকাংশ স্বপ্নের বেশি সম্ভাবনা থাকে যে আপনি রিসেন্ট যেসব চিন্তা করেছেন এবং যেসব কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন এবং আছেন স্বপ্নে তারই প্রতিফলন ঘটে থাকে।

২। বর্তমানে আপনি কোন আবেগের ভিতর দিয়ে যাচ্ছেন। আপনি কি আনন্দ উল্লাসে জীবন পার করতেছেন নাকি দুঃখ বেদনা এবং ডিপ্রেশনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছেন। মানুষের যে আবেগগুলো তীব্র হয় মূলত স্বপ্নে সে বিষয়গুলো চলে আসে।

৩। স্বপ্ন আপনার শৈশবের সাথে সম্পর্কযুক্ত কি না। স্বপ্নে আপনি শৈশবের কী কী  দেখেছেন। শৈশবে পার করা স্থানের সাথে স্বপ্নের স্থান এক কি না। শৈশবের চরিত্রগুলো পরিচিত নাকি অপরিচিত। ঘটনা কি স্বাভাবিক জীবনের মত নাকি অস্বাভাবিক।

৪। স্বপ্নে কখনো কখনো কোনো ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে যুক্ত হতে পারে। একজন মানুষ যে বিশ্বাস নিয়ে বড় হতে থাকে স্বপ্নের মাঝে সেগুলো চলে আসে।

৫। আপনার জীবনের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য কী এবং তা নিয়ে আপনি চিন্তাভাবনা করেন কি না। এসবের সাথে স্বপ্নের কানেকশন কতটুকু।

অনেক সময় স্বপ্ন এসবের কোনো কিছুর সাথে সরাসরি কোনো কানেকশন থাকেনা। তখন আমরা স্বপ্ন দেখি রূপক ভাবে। একজন মানুষ সে অপরাধ করেছে সে অলওয়েজ ভয়ে থাকে সে ধরা পরে যাবে কি না। সে স্বপ্নে দেখতে পারে সাপ তাকে কামড় দিচ্ছে বা তাড়া করছে অথবা সমুদ্র কিংবা নদীর জলে তলিয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি। একজন মানুষের ক্যান্সার হয়েছে বেশিদিন বাঁচবে না। সে ঘুমের মাঝে স্বপ্নে দেখতে পারে যে ঘড়ির কাটা দ্রুত চলছে। একজন ব্যবসায়ী সে ব্যবসায় লস খাওয়ার আশঙ্কায় আছে সে স্বপ্নে দেখতে পারে যে পরীক্ষার হলে সে পরীক্ষা দিচ্ছে সময় চলে যাচ্ছে কিন্তু কলমের লেখা এগুচ্ছে না। এছাড়াও সে দেখতে পারে উঁচু কোনো জায়গা থেকে সে নিচে পড়ে যাচ্ছে। এভাবে ব্যক্তিভেদে স্বপ্নের ভিন্নতা যেমন হয় তেমনি এর ব্যাখাও হবে ভিন্ন।


স্বপ্নের ব্যাখা বের করতে হলে স্বপ্ন মনে রাখতে হবে, লিখে রাখতে হবে এবং বিশ্লেষণ করতে হবে। এভাবে স্বপ্নের একটা প্যাটার্ন তৈরি হবে যা আপনাকে স্বপ্নের মানে আপনি নিজে যাতে বের করতে পারেন সেক্ষেত্রে হেল্প করবে।


ভাল স্বপ্নের কথা যদি বলতেই হয় তাহলে জ্ঞানী ব্যক্তির নিকট বলা উচিত। কিন্তু যদি খারাপ স্বপ্ন হয় তাহলে অন্যের নিকট বলা উচিত নয়।


রাসুল (সা:) বলেছেন যে, “ভাল স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। তাই যখন কেউ পছন্দীয় কোন স্বপ্ন দেখে তখন এমন লোকের কাছেই বলবে, যাকে সে পছন্দ করে। আর যখন অপছন্দীয় কোন স্বপ্ন দেখে তখন যেন সে এর ক্ষতি ও শয়তানের ক্ষতি থেকে আল্লাহর আশ্রয় চায় এবং তিনবার থু থু ফেলে আর সে যেন তা কারো কাছে বর্ণনা না করে। তাহলে এ স্বপ্ন তার কোন ক্ষতি করবে না।”


তৌহিদ রাসেল

www.fb.com/atr.presents
483rasel@gmail.com


Comments

Popular posts from this blog

সমকাম বা হোমোসেক্সুয়াল

বিভিন্ন ধর্মে নারীর পর্দা- তৌহিদ রাসেল

এক নজরে দোহার উপজেলা