লোহা রহস্য
রিফাত অনেকক্ষণ যাবত দাড়িয়ে আছে কিন্তু রাস্তায় কোনো খালি রিক্সার দেখা পাচ্ছে না। যেসব রিক্সা আসছে এবং যাচ্ছে সবগুলাতেই প্যাসেঞ্জার ভর্তি।
এইদিকে রিফাত নিজের উপরে নিজেই রাগ হলো। ফজরের পর ঘুমানোর বদ অভ্যাসের কারনেই উঠতে দেরি হয়ে যাওয়াতে এখন হেটে গেলে ক্লাস নেওয়ার জাস্ট টাইমের চেয়ে লেট হয়ে যাবে। আর অন্যের কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিলে টাইম মেইন্টেইন না করলে তার পরিবর্তে অন্য টিচার নিবে না তার নিশ্চয়তাও নেই। কারন, রিফাতের আগে যে সাইন্সের ক্লাস নিতো সে মাঝে মাঝে কামাই দিতো বলেই তার পরিবর্তে রিফাতকে নেওয়া হয়েছে। এখন রিক্সার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। ফজরের পর ঘুমানোর বদ অভ্যাস আগে রিফাতের ছিল না। ভার্সিতে ভর্তি হওয়ার পর মেসে এসে এই বদ অভ্যাস তৈরি হইছে।
- মামা ইউরেনাস কোচিং সেন্টারে যাবেন?
- হ যামু, উঠেন। তবে ভাড়া ২০ টাকা দিয়েন।
- মামা ঐখানে ভাড়া তো ২৫ টাকা।
- হ মামা ২৫ টাকা। কিন্তু আমার রিক্সা প্যাডেলে চলে বলে কেউ উঠতে চায় না। তাই ৫ টাকা কম নেই যেন প্যাসেঞ্জার ধরতে পারি।
- ও আচ্ছা।
কতদূর যাইতেই রিক্সাওয়ালা মুরব্বী লোকটি হাপিয়ে যাচ্ছে। আর রিক্সার গতিও কমে যাচ্ছে। এইদিকে সময় কম, তাই রিক্সাওয়ালাকে জোরে চালানোর বলতে ইচ্ছা করতেছে রিফাতের। কিন্তু মুরব্বী রিক্সাওয়ালার শারীরিক অবস্থা দেখে আর বললো না। রিক্সা মোড়ল মার্কেটের সামনে আসতেই ভিশন জ্যাম। এখান থেকে হেটে পাচ মিনিট লাগবে কোচিং যাইতে।
- মামা এই নেন টাকা। আমি বাকিটুকু হেটে যাচ্ছি।
- মামা আপনি ৩০ টাকা দিছেন। ১০ টাকা ফেরত নিন।
- মামা আপনি ১০ টাকা রেখে দিন।
- না মামা রাখা যাইবো না। আপনার থেকে ২০ টাকাই রাখব।
এই বলে মুরব্বী রিক্সাওয়ালা লোকটি ১০ টাকা রিফাতের হাতে গুঁজে দিলো। রিফাত আর কথা না বাড়িয়ে কোচিং এর দিকে রওনা হলো। রিফাত রিক্সাওয়ালাকে অনেক আগে থেকেই চিনে। তাই সে ভাবলো তার যদি একটা মোটর রিক্সা থাকতো তাহলে অনেক প্যাসেঞ্জার পেত। কিন্তু মোটর রিক্সা কিনার সামর্থ্য তার নেই।
রিফাত চিন্তা করলো সে কালেকশনে নামবে। কালেকশন টা পাব্লিকলি না করে আগে ক্লুজলি করার চেষ্টা করবে। যদি তাতে ৪০/৫০ হাজার টাকা ম্যানেজ না হয় তাহলে পাব্লিকলি নামবে।
মনে মনে হিসাব করলো প্রথমে তার বন্ধুদের অর্থনৈতিক সংগঠন থেকে কিছু কালেকশন করবে। এরপর দেশে-বিদেশে থাকা কাছের কিছু বন্ধু ও বড় ভাই যারা ভাল পজিশনে আছে তাদের নিকট থেকে কালেকশন করবে। এরপরও যদি পরিপূর্ণ টাকা না পাওয়া যায় তাহলে রিফাত যে সামাজিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত সে সংগঠনের কর্মীদের নিয়ে স্কুল-কলেজ, বাজার এবং দর্শনীয় স্থানে ক্যাম্পেইন করবে। যদি ঐ মুরব্বী রিক্সাওয়ালার জন্য কিছু করা যায় তাহলে সে তার পরিবার নিয়ে একটু ভালভাবে থাকতে পারবে।
ভাবতে না ভাবতেই কোচিং পর্যন্ত চলে আসলো। ক্লাসে ঢুকার আগে মনে পড়লো সে সকালের নাস্তা করেনি। ঘড়িতে চেয়ে দেখলো এখনো ৪ মিনিট বাকি। তাই কোচিং এর পাশে রফিক মামার দোকানে গিয়ে একটা কলা, রুটি এবং এক কাপ চা খেয়ে নিলো ৪ মিনিটের ভিতর।
রিফাত এই কোচিং সেন্টারে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি এবং বায়োলজি পড়ায়। আজ রিফাতের ফিজিক্সের ক্লাস। রিফাত ক্লাসে ঢুকেই জ্যামিতিক আলোক বিজ্ঞান টপিকটা পড়ানো শুরু করলো। রিফাতের এই একটা বৈশিষ্ট্য যে অন্য টিচারদের চেয়ে আলাদা। রিফাত স্টুডেন্টদের সাথে যে গল্প বিনিময় করে না তা না। সেও করে গল্প, সেও হোমওয়ার্ক দেখে এবং যা পড়া দিয়েছিল তা নেয়। তবে তা ক্লাসের শেষের দিকে।
সে মাইক্রোস্কোপ, টেলিস্কোপ চিত্র একে এত সুন্দর করে স্টুডেন্টদের বুঝিয়ে দিলো যে সবার মনে হতে থাকলো মুখস্থ হয়ে গেছে। কিন্তু সবার মাথায় ঢুকলেও সাকিবের মাথায় একটু দেরিতে ঢুকে। তাই দাড়িয়ে আবারও বুঝিয়ে দিতে বললো। রিফাত একটা হাসি দিয়ে সাকিবকে বসতে বলে আবার বুঝানো শুরু করলো। রিফাতের এই একটি গুন তাকে যতবার তার স্টুডেন্টরা বুঝিয়ে দিতে বলবে ততবারই বুঝাবে একটুও বিরক্তিবোধ করবে না। কারন, তার এটা ভিশন ভাল লাগে।
সবাইর বুঝা যখন শেষ এবং ক্লাসও প্রায় শেষের দিকে তখন হোমওয়ার্ক গুলিতে সাইন করে কয়েকজনের পড়া ধরবে তখন স্টুডেন্টরা বলে উঠলো
- স্যার আজ বৃহস্পতিবার আজ গল্প বলার দিন।
- ও আচ্ছা তাই নাকি। ঠিক আছে আজ পড়া ধরব সাথে সাথে গল্পও বলবো।
সবাই ইয়াহু বলে খুশিতে হৈচৈ করে উঠলো।
- সাকিব দাড়াও
- জ্বী স্যার।
- হোমওয়ার্ক কি নিয়ে ছিলো?
- স্যার লোহা নিয়ে ছিল স্যার।
- এখন বলো লোহার প্রতীকী নাম কি?
- স্যার লোহার প্রতীকী নাম হলো Fe.
রিফাত আরেকটা প্রশ্ন সাকিবকে করবে তার আগেই সারাহ দাড়িয়ে বলে উঠলো,
- স্যার আপনি বলেছিলেন পড়া ধরবেন আর গল্প করবেন। কিন্তু পড়াই ধরতেছেন কিন্তু গল্প করতেছেন না।
- আচ্ছা ঠিক আছে গল্প বলবো। তার আগে সারাহ তুমি আমাকে বলো বিজ্ঞানীরা লোহার সৃষ্টি সমন্ধে কি বলেছে?
- বিজ্ঞানীরা বলেছে যে, 'লোহা পৃথিবীতে সৃষ্ট কোন পদার্থ নয়, লোহা এসেছে পৃথিবীর বাইরে থেকে। লোহা কেবলমাত্র সূর্যের চেয়ে বড় কোন নক্ষত্রেই তৈরী হতে পারে যেখানে তাপমাত্রা কোটি ডিগ্রির কাছাকাছি। এ রকম কোন গলিত নক্ষত্রের বিস্ফোরনের মাধ্যমেই লোহার উৎপত্তি সম্ভব।'
- এটা কত বছর আগে বলেছে বিজ্ঞানীরা??
- স্যার ১৭১ বছর পূর্বে বলেছে অর্থাৎ ১৮৪৭ সালে বিজ্ঞানি জুল, ডেভি ও রামফোর্ড কর্তৃক তাপ গতি বিদ্যার ১ম সূত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করার পর।
- এখন তাহলে গল্প শুরু করা যাক। সারাহ তুমি বসো। তোমরা সবাই কি জানো! এইটার প্রায় ১৪০০ বছর আগে লোহার অণুর জটিল গঠন পক্রিয়া, অণুটির আভ্যন্তরীণ বিপুল শক্তি ভাণ্ডার, এই মৌলটি পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়নি, এটি এসেছে আকাশ তথা সৌর জগতের বাইরে থেকে, এইসব জটিল তথ্য গুলো বলা হয়েছে।
- তার প্রমাণ কি স্যার?
সুদীপ্ত দাড়িয়ে একজন যুক্তিবাদীর মত প্রশ্ন করলো। সুদীপ্ত প্রতিটি জিনিস বিশ্বাস করতে চায় যুক্তি ও প্রমাণের মাধ্যমে। তাই এই রকম সিরিয়াস বিষয়ে সে চুপ থাকবে এটা অসম্ভব। আর সে যে প্রমাণ চাইবে সেটা রিফাত আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিল। তাই সুদীপ্তের প্রতিউত্তরে রিফাত বললো,
- তার প্রমাণ আল্লাহ তা'আলা সুরা আল হাদিদে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন- 'আর আমি নাযিল করেছি লৌহ, যাতে আছে প্রচন্ড রণশক্তি এবং মানুষের বহুবিধ উপকার।' এখান থেকে আমরা কি পেলাম! আমরা পেলাম-
১. আল্লাহ লোহা নাযিল করেছেন অর্থাৎ লোহাকে পাঠানো হয়েছে সৌর জগতের বাইরে থেকে।
২. লোহার মধ্যে রয়েছে প্রচন্ড শক্তি অর্থাৎ লোহা অণুর জটিল গঠন পক্রিয়া, অণুটির আভ্যন্তরীণ বিপুল শক্তি ভাণ্ডার।
৩. এবং রয়েছে মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ অর্থাৎ লোহা খুবই উপকারী ধাতু।
জহির অবাক বিস্ময়ে দাড়িয়ে বলে উঠলো,
- স্যার এটা কিভাবে সম্ভব!
- আল্লাহ চাইলে সবই সম্ভব। আচ্ছা জহির তুমি বলোতো পৃথিবীর মধ্যবিন্দু অর্থাৎ কেন্দ্র কি দিয়ে তৈরি।
- স্যার এটা তো খুবই সহজ। পৃথিবীর মধ্যবিন্দু অর্থাৎ কেন্দ্র লোহা দিয়ে তৈরি।
- হুম ঠিকই বলেছো। তুমি কি জানো কুরআনের মধ্যবর্তী সুরার নাম কি??
জহিরের এই উত্তরটি জানা না থাকায় সে আমতা আমতা করতে থাকলো। পিছন থেকে শরীফ দাড়িয়ে বলে উঠলো,
- স্যার কুরআনের মধ্যবর্তী সুরার নাম হলো আল হাদিদ এবং ঐখান থেকে আপনি একটু আগেই একটা আয়াতের কিছু অংশ বলেছিলেন।
- কারেক্ট উত্তর দিয়েছো শরীফ। তোমার স্মৃতি শক্তি দেখি খুবই প্রখর, শরীফ ও জহির বসো। শুনো হাদিদের বাংলা অর্থ হলো লোহা। দেখো কি চমৎকার মিল! পৃথিবীর মধ্যবিন্দু লোহা দিয়ে তৈরি আর কুরআনের মধ্যবর্তী সুরার নাম হাদিদ অর্থাৎ লোহা!
সিয়াম হাশিখুশি চেহারা নিয়ে দাড়িয়ে বললো,
- স্যার গল্প কি এখানেই শেষ?
- না এখনো পড়া ধরাও শেষ হয়নি এবং গল্প বলাও শেষ হয়নি। আচ্ছা সিয়াম তুমি বলো তো লোহার এটমিক নাম্বার অর্থাৎ পারমাণবিক সংখ্যা কত?
- স্যার লোহার পারমাণবিক সংখ্যা হলো ২৬.
- গুড এন্সার। ‘হাদিদ’ শব্দটির সংখ্যাগত মানও হলো ২৬ অর্থাৎ হা=৮, দাল=৪, ইয়া=১০, দাল=৪।
- স্যার এটা কেমনে কি!
- হ্যা এটা অমনেই। আরেকটা বিষয় সেটা হলো কুরআন বিশ্লেষকগণ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিমকে আয়াত হিসেবে গণনা করেন। আর সুরা হাদিদে যদি 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' কে প্রথম আয়াত ধরা হয় তাহলে 'আমি নাযিল করেছি লৌহ' এই কথাটি আসে ২৬ তম আয়াতে। আরেকটা কথা লোহার পারমাণবিক সংখ্যা ২৬ হওয়ায় লোহা পরমাণুর অভ্যন্তরে ২৬টি প্রোটন ও ২৬টি ইলেকট্রন আছে।
এতটুকু বলে রিফাত একটু দম নিলো। এরপর সুদীপ্তকে দাড়াতে বলে রিফাত বললো,
- আচ্ছা সুদীপ্ত তুমি তাহলে বলো লোহা
পরমাণুর নিউক্লিয়াসে অবস্থিত নিউট্রন সংখ্যা কত?
- স্যার নিউট্রন সংখ্যা ৩০।
- হুম ঠিক বলেছো। আর আগেই বলেছি বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিমকে যদি আয়াত হিসেবে ধরা হয় তাহলে সুরা আল হাদিদের সর্বমোট আয়াত দাড়ায় ৩০।
- তাহলে কি স্যার লোহার ভর সমন্ধেও এই সুরায় ব্যাখা আছে?
- হ্যা সুদীপ্ত তাও আছে। তুমি আগে বলো লোহার পারমানবিক ভর কত?
- স্যার প্রোটন সংখ্যা+নিউট্রন সংখ্যা = ভরসংখ্যা অর্থাৎ লোহার ভর সংখ্যা হলো ৫৬।
- ধন্যবাদ সুদীপ্ত, সূত্রসহ বলার জন্য। এখন আমরা হাদিদ শব্দের সংখ্যাগত মান ২৬ + হাদিদের আয়াত (বিসমিল্লাহ সহ) ৩০ = ৫৬ পাই। একটু আউলাঝাউলা মনে হইলে খাতা কলমে সবাই মিলিয়ে দেখতে পারো।
সবাই খাতা কলম নিয়ে হিসাব মিলাতে শুরু করলো। রিফাত ক্লাস শেষ করে বের হয়ে যাচ্ছিলো। সুদীপ্ত বিশ্বাস দাড়িয়ে বললো,
- স্যার আমি কুরআনের বাংলা অনুবাদ টা পড়তে পারবো??
- হ্যা অবশ্যই পারবে। কুরআন তো শুধু মুসলিমদের জন্য নাযিল হয়নি। আল্লাহ বলেছেন এটা তিনি নাযিল করেছেন সমগ্র জ্বীন এবং ইনসানের জন্য।
রিফাত স্যার চলে যাওয়ার পর ক্লাসে একটা আনন্দের গুঞ্জন তৈরি হলো। সুদীপ্ত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্যারের প্রস্থান হওয়া দেখতেছিল নাকি কিছু ভাবতেছিল সেটা কেউ খেয়াল করেনি।
Comments
Post a Comment