নেপালের পরিচিত, নেপালের রাজনীতি এবং বৈদেশিক সম্পর্ক


ভারতের মানুষ যতটা না চিন্তিত, বাংলাদেশের মানুষ তার চেয়ে বেশি আলোচনায় ব্যস্ত ভারতের রাজনীতি নিয়ে। বাড়ির ভাত খেয়ে বনের মহিষ তাড়ানোর মত ব্যাপারটা। ভারত সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের উপর যতটা না প্রভাব বিস্তার করেছে তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে নেপালের উপর।

নেপালকে আমরা বাংলাদেশিরা চিনি এভারেস্টের দেশ হিসেবে। আজ না হয় রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটু দেখার চেষ্টা করব। দৈনিক প্রথম আলো, নয়া দিগন্ত, কালের কণ্ঠ, ইনকিলাব, বিবিসি বাংলা, ঢাকা টাইমস, উইকিপিডিয়া সহ বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইট এবং ব্লগ থেকে লেখা গুলি সংগ্রহ করে উপস্থাপন করা হলো।

এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে নেপালের পরিচিত, রাজনীতি, নেপালের রাজনীতিতে ভারত ও চীনের প্রভাব, শরণার্থী সমস্যা এবং  নেপাল বাংলাদেশ সম্পর্ক ইত্যাদি।

প্রথমে নেপালের সংক্ষিপ্ত পপরিচয় তুলে ধরা যাক। নেপাল হিমালয় অধ্যুষিত একটি দক্ষিণ এশীয় দেশ যার সাথে উত্তরে চীন এবং দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে ভারতের সীমান্ত রয়েছে। এর শতকরা ৮১ ভাগ জনগণই হিন্দু ধর্মের অনুসারী। বেশ ছোট আয়তনের একটি দেশ হওয়া সত্ত্বেও নেপালের ভূমিরূপ অত্যন্ত বিচিত্র।

আর্দ্র আবহাওয়া বিশিষ্ট অঞ্চল, তরাই থেকে শুরু করে সুবিশাল হিমালয়। সর্বত্রই এই বৈচিত্র্যের পরিচয় পাওয়া যায়। নেপাল এবং চীনের সীমান্ত জুড়ে যে অঞ্চল সেখানে পৃথিবীর সর্বোচ্চ ১০ টি পর্বতের ৮ টিই অবস্থিত। এখানেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট অবস্থিত।

নেপাল নামটির সঠিক উৎপত্তি সম্বন্ধে জানা যায়নি, তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় মত অনুসারে নেপাল নামটি দুটি শব্দ নে এবং পাল থেকে এসেছে যাদের অর্থ যথাক্রমে পবিত্র এবং গুহা। তাহলে নেপাল শব্দের অর্থ দাঁড়াচ্ছে পবিত্র গুহা।

নেপালের রাজধানী কাঠমুন্ডুর উপত্যকায় প্রাপ্ত নিওলিথিক যুগের বেশকিছু উপাদান এটিই নির্দেশ করে যে হিমালয়ান অঞ্চলে প্রায় ৯০০০ বছর থেকে মানুষ বসবাস করছে। এটি প্রতিষ্ঠিত যে প্রায় ২৫০০ বছর পূর্বে নেপালে তিব্বতী- বার্মীয় জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল।

১৫০০ খৃস্টপূর্বাব্দে ইন্দো ইরানীয় বা আর্য জাতিগোষ্ঠী এই হিমালয়ান উপত্যকায় প্রবেশ করে। ১০০০ খৃস্টপূর্বাব্দের দিকে এই অঞ্চলটিতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য স্বতন্ত্র রাজ্য ও কনফেডারেশন গড়ে উঠে। এরকমই একটি কনফেডারেশন ছিল সাকিয়া যার একসময়কার রাজা ছিলেন সিদ্ধার্থ গৌতম, যিনি গৌতম বুদ্ধ বা শুধু বুদ্ধ নামেই পরিচিত। তিনি পবিত্র ও সাধনাময় জীবনযাপনের জন্য তার রাজত্ব ত্যাগ করেছিলেন।

বর্তমানে নেপালের রাজনীতি একটি বহুদলীয়

প্রজাতন্ত্রের কাঠামোতে সংঘটিত হয়। প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকার প্রধান। সরকারের হাতে নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত। আইনসভার উপর আইন প্রণয়নের দায়িত্ব ন্যস্ত। বর্তমানে বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারী নেপালের রাষ্ট্রপতি এবং পুষ্প কমল দহল প্রচণ্ড নেপাল প্রধানমন্ত্রী।

২০০৮ সালের মে মাস পর্যন্ত নেপাল একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ছিল। ঐ মাসের ২৮ তারিখে নেপালের আইনসভা সংবিধানে সংশোধন আনে এবং নেপালকে একটি প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত করে।

নেপালে যেসব রাজনৈতিক দল রয়েছে তা হলো-

১. নেপালি কংগ্রেস
২. নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (একীকৃত মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী)
৩. নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (সংযুক্ত মার্কসবাদী)
৪. নেপালের কম্যুনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)
৫. মধেসী জনাধিকার ফোরম
৬. তরাঈ মধেস লোকতান্ত্রিক পার্টি
৮. নেপাল মজুর কৃষক পার্টি

নেপালের অর্থনীতি মূলত পর্যটন শিল্পের উপর নির্ভরশীল। প্রত্যেক বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে হাজারো মানুষ নেপার ভ্রমণ করে।

নেপালের সংস্কৃতি অনেকগুলো দেশীয়, আদিবাসী গোষ্ঠীর সংস্কৃতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে, ফলে নেপাল এক বহুসাংস্কৃতিক রাষ্ট্র। নেপালের সংস্কৃতি বেশ সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ, বিশেষকরে নেওয়ার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি। নেওয়ার জনগোষ্ঠী অনেকগুলো পার্বণ পালন করে এবং তারা তাদের গান ও নাচের জন্য সুপরিচিত।

নেপালের অন্যান্য দিক থেকে নেপালের রাজনীতির উপর বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে ভারত ও চীন। ভারত চায় নেপালকে তার ‘প্রভাব বলয়ে’ রাখতে, আর চীন চায় তার শক্তি বাড়াতে। ভারতের দৃষ্টিতে নেপালে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব শুধু ব্যবসা বাণিজ্যের সাথেই সম্পর্কিত নয়, বরং তা দক্ষিণ এশিয়াকে বৃত্তাবদ্ধ করার তাদের বৃহত্তর কৌশলগত লক্ষ্যের অংশবিশেষ।

সত্যিকার অর্থেই সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলোতে নেপালে ভারত ও চীনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে নেপালে ভারত প্রায় বিশেষ প্রভাব উপভোগ করেছে। অবশ্য গত দশকে, প্রধানত ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র বিলোপের পর, অন্যান্য আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়, বিশেষ করে চীন, প্রধানত রাজনৈতিক বিষয়াদিতে নেপালে তাদের প্রভাব বাড়িয়েছে।

একই সময়ে নেপালে চীন তার কূটনীতিকে ‘নীরব কূটনীতি’ থেকে ‘সরব’ কূটনীতিতে নিয়ে গেছে। নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয়াদি নিয়ে চীন তাদের উদ্বেগ ক্রমবর্ধমান হারে প্রকাশ করছে, ঠিক যেভাবে ভারত দীর্ঘ দিন করেছে। গত বছর নেপালের সরকার পরিবর্তন খেলায় চীনকেও টেনে আনা হয়েছিল।

২০১৫ সালে নেপাল তার সংবিধান চূড়ান্ত করে এবং ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্কে টানাপোড়েনের মধ্যে নেপাল ও চীনের মধ্যকার লেনদেন ও আদানপ্রদান ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। নেপাল-ভারত সীমান্তে ভারতের অবরোধ আরোপ করার অভিযোগের পর ভারত তা অস্বীকার করে নিত্যপণ্যের প্রয়োজন মেটানোর জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠে, যদিও চীনের সাথে তার বাণিজ্য পর্যাপ্ত নয়।

নেপাল ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনার ফলে বিশেষ করে রাজনীতিতে ভূমিকা রাখার সুযোগ সৃষ্টি করে চীনের জন্য। এ সময় কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউনিফাইড মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট) অথবা সিপিএন-ইউএমএল চেয়ারম্যান কে পি ওলি’র নেতৃত্বাধীন নেপাল সরকার চীনের সঙ্গে ব্যবসা ও  ট্রানজিটবিষয়ক চুক্তি সই করে। এর মধ্য দিয়ে তারা নেপালের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভারতের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটায়।

একইভাবে নেপাল-ভারত যৌথ উদ্যোগে রেলওয়ে সম্প্রসারণ ও সড়ক সংযোগসহ বেশ কিছু প্রকল্প গতি পায়। ওলি সরকারের সঙ্গে কাজ করে স্বস্তিতে ছিল চীন সরকার। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ন্ত্রিত দ্য গ্লোবাল টাইমসসহ চীনা মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিষয়টির প্রমাণ পাওয়া যায়। ওলির নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর এবং পুস্প কমল দাহাল ওরফে প্রচন্ডের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর চীনা মিডিয়ায় ওলির আমলে করা চুক্তিগুলো বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।

এদিকে, ভারত আশা করে, প্রচন্ডের নেতৃত্বাধীন সরকার ভারতের প্রতি আরো বেশি অনুকূল হবে। একইভাবে তারা আশা প্রকাশ করে, নেপালে চীনের প্রভাবও কমে গিয়ে ভারতকে তার আগের প্রভাবমূলক অবস্থানে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেবে। তবে ক্ষমতায় এসেই প্রচন্ড ঘোষণা করেন, তিনি ভারত ও চীনের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখবেন। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে নয়াদিল্লি ও বেইজিংয়ে বিশেষ দূত পাঠিয়ে তার সরকারের অগ্রাধিকার এবং সেইসাথে উভয়ের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখার আকাক্সক্ষা সম্পর্কে দু’দেশের সরকারকে অবহিত করেন।

কিন্তু এ ধরনের বাগাড়ম্বরতার মধ্যেও প্রচন্ডের নেতৃত্বাধীন সরকার ভারতের ঝুঁকছে বলে অভিযোগের মুখে পড়ে। নতুন সরকার গঠনের এক মাস পর তিনি রাষ্ট্রীয় সফরে ভারত যান। তার এই সফরের পর পরই ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী নেপাল সফর করেন। ১৮ বছরের মধ্যে তিনিই প্রথম ভারতীয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে নেপাল সফর করলেন।  তবে নেপালে নতুন সরকার গঠনের পর থেকে নেপাল ও চীনের মধ্যে এমন উচ্চপর্যায়ে কোনো সফর হয়নি। নেপালের প্রধানমন্ত্রী প্রচন্ডের চীন সফর ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের নেপাল সফরের বিষয়টি অচলাবস্থায় রয়েছে।

২০১৬ সালে নেপাল সফরে আসার কথা ছিল শি জিন পিংয়ের। কিন্তু হিমালয় রাষ্ট্রটিতে ‘এক অঞ্চল -এক সড়ক’ (ওয়ান বেল্ট-ওয়ান রোড) উদ্যোগটি বাস্তবায়ন না করায় সফরটি হয়নি। পূর্ব এশিয়া থেকে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত চীনের এই বিশাল কানেকটিভিটি প্রকল্পটি নিয়ে কয়েকটি চুক্তিতে সই করার জন্য পরে চীন চাপ দিতে থাকে। তবে এক্ষেত্রে ভারতের সাড়া ইতিবাচক নয়।

এ সমস্যা কেবল প্রচন্ডের জন্য নয়। নেপালের সাম্প্রতিক সব প্রধানমন্ত্রীই এ দুই প্রতিবেশীর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, নেপালের প্রধানমন্ত্রী এবং রাজনীতিবিদেরা অল্প সময়ের মধ্যেই হয় চীনপন্থী কিংবা ভারতপন্থী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাচ্ছেন। অথচ দেশের সমৃদ্ধির জন্য তাদের প্রয়োজনীয় সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক কল্যাণ হাসিল করতে উভয় প্রতিবেশীর সাথেই আন্তরিক সম্পর্ক সৃষ্টি করা উচিত।

নেপালের সঙ্গে ভারতের বৈরিতার শুরু ২০১৫ সালে। সে বছর নেপাল তার সংবিধান রচনার সময় দিল্লির মতামত না শোনায় নাখোশ হয় ভারত। এর প্রতিক্রিয়ায় ২০১৬ সালে ভূমিকম্প বিধ্বস্ত নেপালে কয়েক মাসের অবরোধ দেয় ভারত। ল্যান্ডলক দেশটিতে জ্বালানি তেল, ওষুধ থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যাপক সংকট তৈরি হয়।

নেপালের জনগণের একটা বড় অংশের মাঝে শুরু হয় ভারতবিরোধিতা। ভারত সীমান্তবর্তী নেপালের সমতল ভূমির বাসিন্দা, যারা মধেশি হিসেবে পরিচিত, তারা আরও বেশি ক্ষমতার কেন্দ্রে আসতে চাইলে সাংবিধানিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। ভারতের তরফ থেকে নেপালের ওপর চাপ তৈরি হয় মধেশিদের সুযোগ দেওয়ার জন্য। মধেশিদের অধিকাংশই এক সময় ভারত থেকে নেপালের তরাই অঞ্চলে গিয়ে বসতি স্থাপন করেছিল। ভারতের সঙ্গে মধেশিদের ঘনিষ্ঠতা দীর্ঘদিনের।

২০১৫-১৬ সালে ভারতের নেপাল অবরোধের পর ব্যাপক ভারতবিদ্বেষী মনোভাবের জন্ম হয় সে দেশের মানুষের মধ্যে। ওই সময়টাতে ওলি চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ভারতবিরোধী জাতীয়তাবাদকে কাজে লাগিয়েই মূলত ২০১৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে ওলির দল কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল-ইউনিফাইড মাকর্সিস্ট-লেনিনিস্ট সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রীর পদে বসেন ওলি। ওই সময়টাতে ওলিকে এক প্রকার বিচ্ছিন্ন করে ফেলার চেষ্টা করা হয় ভারতের পক্ষ থেকে। তখন তিনি প্রথমবারের (অক্টোবর ২০১৫-আগস্ট ২০১৬) মতো নেপালের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির সুযোগে নেপালের পাশে দাঁড়ায় চীন। ভারতের ভূমিকাগুলো পালন করতে থাকে চীন। চীনের বন্দরগুলো ব্যবহার করার সুযোগ করে দেওয়া হয় নেপালকে। প্রতিদানে চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড (ওবিওআর) প্রকল্পে বেশ উৎসাহ নিয়েই যোগ দেয় নেপাল। কাপালে ভাঁজ পড়ে দিল্লির। ওলির এবারের সফরে গত কয়েক বছরের নেপাল-ভারত ভঙ্গুর সম্পর্কে কিছুটা জোড়া লাগার হাওয়া লেগেছে। বিশ্নেষকরা বলছেন, চীনপন্থি হলেও ওলিকে কেন্দ্র করেই পুরনো সম্পর্ক নতুন করে ঝালাই করতে চাচ্ছে ভারত।

তার কিছু আলামতও পাওয়া গেছে এর মধ্যে। প্রথম দফায় প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওলির ভারত সফরের সময় কোনো যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয়নি দুই দেশের তরফ থেকে। এবার শুধু বিবৃতিই দেওয়া হয়নি, ভারতের সঙ্গে তিনটি চুক্তিতেও পৌঁছেছে দেশটি। এর একটি বিহার থেকে কাঠমান্ডু পর্যন্ত রেল যোগাযোগ। যাতে অর্থায়ন করবে ভারত। এই প্রকল্পকে চীন থেকে নেপালে রেললাইন বসানোর পাল্টা পরিকল্পনা হিসেবে দেখছেন অনেক। ওই রেললাইন ভারত-নেপাল সীমান্ত পর্যন্ত নিয়ে যেতে চায় চীন। বাকি দুই চুক্তির একটি অন্তঃপানিপথ-সংক্রান্ত এবং বাকিটি কৃষি-সংক্রান্ত। ভারতের অভ্যন্তরীণ পানিপথ ব্যবহার করে ল্যান্ডলক নেপাল সমুদ্রের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেত চায়। মোদি বলেছিলেন, 'আমরা হিমালয়ের সঙ্গে সমুদ্রের সংযোগ ঘটাব।'

ওবিওআর প্রকল্প নিয়ে আঞ্চলিক সংযোগের দিকে মনোযোগ দিয়েছে চীন। নেপাল এই প্রকল্পের অন্যতম অংশীদার। নেপালে একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে চীন। রয়েছে আরও অনেক প্রকল্প। ভারতের এই তিন প্রকল্পকেই দেখা হচ্ছে চীনের প্রকল্পগুলোর পাল্টা হিসেবে। বিগত দুই দশকে চীন ছোট ছোট জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দিকে ব্যাপক মনোযোগ বাড়িয়েছে।

আবার চীনের কাছে নেপালের ভৌগোলিক গুরুত্বও অনেক। কারণ এই নেপালকে ব্যবহার করেই ভারত এতদিন তিব্বতে চীনবিরোধী কার্যক্রমে জ্বালানি জুগিয়েছে। আবার চীনের দমন-পীড়নের হাত থেকে বাঁচতে এই নেপালকে ব্যবহার করেই তিব্বতের নেতৃস্থানীয়রা ভারতে চলে এসেছে। ভারতে প্রায় ৩ লাখ তিব্বতি বসবাস করছে। তাদের নেতা দালাই লামাও আশ্রয় নিয়েছেন ভারতে। কাজেই নেপালের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের উন্নতির পেছনে 'তিব্বত ফ্যাক্টর' বড় বিষয়।

চীন চাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়া ও এই উপমহাদেশে ভারতকে একদিকে পাকিস্তান অন্যদিকে, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটানের মতো তার পছন্দের, তার ওপর নির্ভরশীলদের নিয়ে সাজানো ‘স্ট্রিং অফ পার্ল’-এর মতো দেশগুলো দিয়ে ঘিরে ফেলতে। এজন্য ওই দেশগুলোকে বেশি বাণিজ্য-সুবিধা দেবে বেজিং। দেবে অর্থসাহায্য। প্রযুক্তি সাহায্য। বিভিন্ন পণ্যের ওপর চাপানো শুল্কে দেবে ছাড়। এটা নেপাল, ভুটানের মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলির খুব প্রয়োজন। নেপাল কার্যত ‘ল্যান্ড-লক্‌ড স্টেট’। তার এক দিকের কিছুটা তিব্বত, কিছুটা ভূটান।

অন্যদিকে নেপালের সীমান্তের বেশির ভাগটাই ভারতের সঙ্গে। এর ফলে, ভারতের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল নেপাল। কলকাতা আর বিশাখাপত্তনম বন্দর ছাড়া নেপালের সামনে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আর কোনো ‘রুট’ এতদিন খোলা ছিল না। চীন, তিব্বত বা অন্য দেশের মাধ্যমে নেপালের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অনেক বেশি ব্যয়সাপেক্ষ হয়, সেখানকার বন্দরগুলি অনেক দূরে বলে।

চীন এবার তার দু’টি বন্দর নেপালকে ব্যবহার করতে দেবে বলেছে। যদিও দূরত্বে তা কলকাতা বা বিশাখাপত্তনম বন্দরের চেয়ে অনেক বেশি। তবে তারচেয়েও বড় কথা, লাসা থেকে কাঠামান্ডুর অত্যন্ত দুর্গম পথে চীন উন্নত সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে নেপালকে। এতে সত্যিই অনেকটা উপকার হবে নেপালের। ভারতের ওপরেও তার নির্ভরতা কমবে।

চীনের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ার খেসারত অবশ্য দূর ভবিষ্যতে ভালই দিতে হবে কাঠমান্ডুকে। নেপালের রাজনীতিতে নাক গলাবে চীন। সেটা বামপন্থীরা ক্ষমতায় থাকলে নেপালের পক্ষে মেনে নেয়া যতটা সম্ভব হবে, জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতাসীন হলে তা ততটা হবে না।

হিমালয় পাদদেশের পাহাড়ি দেশ ভুটানে রয়েছে ২০টি ভাষা৷ এই ভাষাভাষীদের সংখ্যা একেবারে কম নয়, আটষট্টি লাখ৷ শত বছর ধরে বিভিন্ন ভাষাভাষীর লোকেরা ভুটানি ভাষী জনগণের সঙ্গে দারুণ এক সৌহার্দ্য নিয়েই বাস করে আসছিলেন৷

কিন্তু সমস্যাটি বাঁধলো ১৯৮৮ সালে৷ সে সময়ে করা জরিপে সে দেশের সরকার দেখতে পেলো, দেশের দক্ষিণ প্রান্তের দুই জেলায় নেপালী ভাষী মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে৷ এই নেপালী ভাষীরা মূলত নেপাল থেকে নানা কারণে পার্শ্ববর্তী দেশ ভুটানে এসে বসবাস করছেন৷ এরা মূলত শরণার্থী হিসাবেই চিহ্নিত৷

তখন এই ভাষাভাষী মানুষকে নিয়েই শংকায় পড়ে গেল সেখানের সরকার৷ তারা মনে করছে, এর ফলে ভুটানীদের আত্মপরিচয় এবং সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখোমুখি হবে৷ আর তাই সরকার লক্ষাধিক নেপালী শরণার্থিকে বহিষ্কার করে পাঠিয়ে দেয় নিজ দেশ নেপালে৷

নেপাল সেই শরনার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাদেরকে নিজ দেশের নাগরিক হিসাবে মেনে নেয়নি৷ কিন্তু এভাবে তো আর চলতে পারে না৷ তাই এগিয়ে এসেছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন বা ইউএনএইচসিআর৷ তারা এদের জন্য তৈরি করে দিয়েছে বাস্তু৷ দিচ্ছে রেশনও৷

ভুটান সরকারের কাছ থেকে বিতাড়িত হওয়া অনেক নেপালী শরণার্থী ইতিমধ্যে পাড়ি জমিয়েছে তৃতীয় দেশে৷ এদের সংখ্যা একেবারে কম নয়৷ ৩৩ হাজার৷ এদের বেশীরভাগ অংশই আশ্রয় নিয়েছেন মার্কিন মুল্লুকে৷ আর এ কাজে সহায়তা করেছে খোদ ইউএনএইসসিআর৷

নেপালে এই অফিসের মুখপাত্র নিনি গুরুং জানালেন, ‘‘তারা আমাদেরকে এখন ই-মেল লেখে, সময় পেলে টেলিফোন করে৷ তারা তাদের জীবনের কথা আমাদের জানায়৷ আমরা জেনে খুবই খুশি হয়েছি, যে তৃতীয় দেশের মূল ধারার সঙ্গে যেন কোন সমস্যা না হয় তাই, তারা সেখানকার ভাষা শিখছেন৷ এদের অনেকেই নানা চাকরিও পেয়ে গেছেন৷''

অনেকের কাছে ভুটান দেশটি সাংগ্রি-লা হিসেবে পরিচিত। সাংগ্রি-লা অর্থ মোট জাতীয় সুখের দেশ। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, মোট জনসংখ্যার এক-ষষ্ঠমাংশ লোককে দেশ ছাড়তে বাধ্য করে তারা কীভাবে সুখে থাকতে পারে।

জাতিগত শুদ্ধিতার নামে অভিযান শুরুর হুমকি লাভের পরই নেপালি ভুটানিরা সীমান্ত অতিক্রম করে চলে এসেছিল ভারতে। সেখানেও তাদের ঠাঁই মিলেনি। ভারতের সীমান্তরক্ষীরা তাদের ঠেলে দিয়েছিল নেপালে। বিশ্লেষকদের অভিমত, এ সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে ভারত। কিন্তু রহস্যজনকভাবে তারাও নীরব রয়েছে; ভুটান সরকারকে এ ব্যাপারে কিছু বলা বা চাপ দেয়ার প্রয়োজন মনে করছে না।

এক লক্ষেরও বেশি লোতশাম্পা (নেপালি বংশোদ্ভূত ভুটানিরা এ নামেই পরিচিত) রাষ্ট্রহীন অবস্থায় রয়েছে। ভুটান ১৯৮০’র দশকের শেষ দিকে “এক জাতি, এক জনগণ” নীতি চালুর পরই বস্তুত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল লোতশাম্পা সংস্কৃতি। এটি অনুসৃত হয়েছিল নাগরিকত্ব আইনের সংস্কার দ্বারা।

৯০’র দশকের শুরুতেই নেপালি ভুটানিরা ভালোভাবেই টের পেয়ে যায় যে, নতুন নীতি মানলে নাগরিক হওয়ার যোগ্যই নয় তারা। কাজেই সীমান্ত অতিক্রম করা ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো রাস্তা খোলা ছিল না।

গত ২৪ বছরে শরণার্থী শিবিরে ঠাঁই হওয়া ৯০ হাজার নেপালি-ভুটানিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তৃতীয় কোনো দেশে। যে এক-চতুর্থাংশ এখনো নেপালে রয়েছে তাদের বেশিরভাগই জন্মভূমিতে ফেরার স্বপ্ন দেখে; কিন্তু তাদের স্বপ্ন পূরণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আপাতত নেই। নেপালি-ভুটানিদের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ চলে গেছে যুক্তরাষ্ট্রে।

তবে অনেকে যুক্তরাষ্ট্র কেন, ভুটান বাদে পৃথিবীর কোথাও যেতে রাজি হচ্ছে না। তাদের স্বপ্ন একটাই, মাতৃভূমিতে ফেরা। বিশ্বাস করে, জীবদ্দশাতেই সমাধান ঘটবে এবং তাদেরকে ফেরানোর জন্য ভুটান তার সীমান্ত খুলে দেবে। ভুটানের বর্তমান রাজশাসন শুরুর অনেক আগে তাদের পূর্বপুরুষেরা নেপাল ছেড়ে ভুটানে গিয়েছিল। ওখানকার সাথে তাদের নাড়ির সম্পর্ক। মনে করে, ওটিই তাদের দেশ; কায়মনে প্রার্থনা করে, মৃত্যুটা যেনো ভুটানে গিয়ে হয়।

ভারত-ভুটান সীমান্তের কাছাকাছি ভুটানের একটি গ্রামে এখন পর্যন্ত কিছু লোতশাম্পা মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছে। কিন্তু তারা ভোগ করছে অবর্ণনীয় কষ্ট। অসুবিধার কথাগুলো কারো কাছে বলতেও ভয় পায়। সংখ্যাগুরু দ্রুকপারা প্রায়ই তাদেরকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলে। এমনকি অনেকে মেরে ফেলার হুমকি পর্যন্ত দেয়।

যে কারণে সবসময়ই তারা আতঙ্কে থাকে। নাগরিক নয় বলে রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধাগুলোতে তাদের কোনো অধিকার নেই। তারপরও তারা থাকতে চান জন্মভূমিতে। ভুটানকেই যে তারা নিজেদের দেশ মনে করে।

নেপাল–বাংলাদেশ সম্পর্কের ব্যাপারে বলতে গেলে নেপাল ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ক হচ্ছে দ্বিপার্শিক সম্পর্ক। যদিও নেপাল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে একটি নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করেছিলো, তবুও যুদ্ধশেষে ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলো। এর ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান সরকার নেপালের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়।

নেপাল সরকার বঙ্গোপসাগরের বন্দর ব্যবহার করার জন্য অনেক আগে থেকেই দাবি জানিয়ে আসছিলো। কিন্তু বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের অংশ ছিলো, তখন তারা খুব বেশি সুবিধা আদায় করতে পারে নি। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ফলে তাদের জন্য ভালো একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়।

১৯৭৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশে নতুন সরকার ব্যাবস্থা কায়েম হলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আরো উন্নতি সাধিত হয়। উভয় দেশ তাদের শক্তিশালী প্রতিবেশীর প্রভাব মোকাবেলার পথ খুঁজছিলো। ১৯৭৬ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ ও নেপাল পরস্পরের মধ্যে বাণিজ্য, ট্রানিজিট এবং বেসামরিক বিমান চলাচলের উন্নয়নের জন্য একটি দিপাক্ষিক চুক্তি করে। ট্রানজিট চুক্তির মাধ্যমে রুটের সমস্ত যানবহন বিভিন্ন দায়িত্ব ও মূল্য প্রদান করা থেকে অব্যাহতি পায়।

নেপালি যানবহন প্রবেশ ও বাহির হওয়ার জন্য ৬টি স্থান নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সীমান্তে এসে নেপালি পণ্য ট্রাক থেকে নামানো হয়, কারণ সরাসরি নেপালি ট্রাক বন্দর পর্যন্ত যাওয়ার কথা চুক্তিতে ছিলো না। ১৯৮৬ সালে ভারতের সাথে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তিতে বাংলাদেশের সাথে শরীক হওয়ার জন্য নেপালের প্রতি দাবি জানায়।

দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অগ্রগতি সত্ত্বেও তাদের পারস্পরিক বিদ্যমান বাণিজ্যের পরিমাণ বছরে ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চেয়েও কম। ২০০৮-০৯ অর্থ-বছরে বাংলাদেশ নেপালে প্রায় ৬.৭ মিলিয়ন ডলার রপ্তানী করে। রপ্তানী পণ্যের মধ্যে ছিলো ওষুধ, গার্মেন্টস, প্লাস্টিক, হস্তশিল্প ও অন্যান্য পণ্য। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে নেপালে প্রায় ৫৩ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে, যা মূলত কৃষি উৎপাদিত, যেমন ডাল, চাল, গম ইত্যাদি।

১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ফুলবাড়ি চুক্তি হওয়ায় ভারতের একটি ট্রানজিট রুটের মাধ্যমে বাংলাদেশে নেপালি পণ্য প্রবেশাধিকার পায়। ২০১০ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি যৌথ ইশতেহার জারি করে নেপাল ও ভুটানকে বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের সুবিধা দেওয়া হয়। উভয় দেশের বাণিজ্য সচিবকে একটি বিস্তারিত ট্রানজিট চুক্তি অনুমোদনের জন্য পরস্পরের সাথে আলোচনা করার এবং চুক্তি বাস্তবায়নের সময় বেধে দেওয়া হয়।

Comments

Popular posts from this blog

সমকাম বা হোমোসেক্সুয়াল

বিভিন্ন ধর্মে নারীর পর্দা- তৌহিদ রাসেল

এক নজরে দোহার উপজেলা